
স্টাফ রিপোর্টার:
করোনা ভাইরাসের কারণে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে। সবশেষ ১৭১ কারখানার ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে ৩৮ কোটি ডলারের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশে থেকে পোশাক নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে দেশের পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
শিল্প মালিকরা বলছেন, বর্তমানে যে কাজ আছে তা নিয়ে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ কারখানা সচল রাখা যাবে। এছাড়া একই ছাদের নিচে অনেক শ্রমিক কাজ করায় রয়েছে সংক্রমণের ঝুঁকিও। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কারখানা চালু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়া হবে।
গতকাল রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম ভবনের সম্মেলন কক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান-এর সভাপতিত্বে সরকার, মালিক ও শ্রমিক ত্রিপক্ষীয় সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়।
সভায় বিকেএমইএ-এর সভাপতি একেএম সেলিম ওসমান এমপি, আবদুস সালাম মুর্শিদী এমপি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আলী আজম, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একেএম মিজানুর রহমান, বিজিএমইএ-এর সভাপতি ড. রুবানা হক, এফবিসিসিআই এর সহ-সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান, জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি ফজলুল হক মন্টু উপস্থিত ছিলেন।
বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, করোনার কারণে কোনো কারখানা এখনও বন্ধ হয়নি। তবে পণ্যের শিপমেন্ট সব বন্ধ হয়ে গেছে। ক্রেতারা বলছে, তারা পণ্য পরে নেবে। তবে কবে নেবে তার কোনো দিনক্ষণ জানি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কারও কোনো কাজ থাকবে না। কাজ না থাকা মানে কারখানা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাওয়া।
জানা গেছে, করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে, যার প্রভাব পড়ছে পোশাক শ্রমিকদের মধ্যেও। আতঙ্কের পাশাপাশি বাড়ছে ঝুঁকি। শ্রমিক সংগঠনগুলোও তুলেছে কারখানা বন্ধের দাবি। একদিকে কাজ কমে আসা, অন্যদিকে শ্রমিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি, সব মিলিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেয়া উচিত বলে মনে করছেন মালিকদের একটি অংশ। আবার আরেকটি অংশ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে কারখানা চালু রাখার পক্ষে এখনো। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সচল না বন্ধ ঘোষণা করা হবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএ। তারা তাকিয়ে আছে শ্রম মন্ত্রণালয়ের দিকে।
অবশেষে সভায় সিদ্ধান্ত এলো। সভায় শ্রমিকদের করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আরো সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দেয়া হয়। কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ করার জন্য মালিকপক্ষকে অনুরোধ করা হয়। সভায় মালিকপক্ষ থেকে জানানো হয় বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনায় ক্রেতারা ইতিমধ্যে অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল করেছেন। এতে উৎপাদন এবং রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের আহ্বানের দাবি জানান।
কারখানা পর্যায়ে শ্রমিকদের মাঝে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের কোন লক্ষণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে সভায় তথ্য উপস্থাপন করা হয়। পরবর্তিতে পরিস্থিতি বিবেচনায় সার্বিক বিষয়ে সরকার মালিক-শ্রমিক আলোচনা অব্যাহত রাখবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদী এমপি জানান, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ পোশাক যায় ইউরোপের বাজারে। করোনা ভাইরাসের কারণে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না। পণ্যের অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। এতে আমরা নতুন করে কাপড় কাটতে পারছি না। ব্যাংক থেকেও আমাদের লোন ছাড় করছে না। কারখানাও বন্ধ রাখতে পারছি না। আমরা খুবই আতঙ্কের মধ্যে আছি। এখন আমরা ক্রেতা ও সরকারি সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি। শ্রমিকদের কোত্থেকে বেতন-ভাতা পরিশোধ করবো তা নিয়েও টেনশনে আছি।
পোশাক কারখানা বন্ধের দাবি: করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে পোশাকশ্রমিকদের রক্ষা করতে পোশাক কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। একই সঙ্গে শ্রমিকদের বেতনসহ ছুটি দিতে সরকার ও পোশাকশিল্প মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতিএক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান। তারা সাময়িকভাবে কারখানা বন্ধের পাশাপাশি পোশাকশ্রমিকদের চলতি মাসের মজুরি, যাতায়াত ভাতাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দেন।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে পোশাক কারখানা আছে প্রায় ৪ হাজার ৬২১টি। এর মধ্যে সরাসরি রপ্তানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে প্রায় আড়াই হাজার। এ খাতে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। সামপ্রতিক করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এ শ্রমিকদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)।
করোনা নিয়ে আতঙ্ক ও ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়েই সতর্কতা ও সচেতনতামূলক পদক্ষেপও গ্রহণ করতে শুরু করেছে বিজিএমইএ। বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি জানিয়েছে, তারা সব সদস্য প্রতিষ্ঠানকে সরকারের ‘নভেল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক নির্দেশিকা প্রচার করতে বলেছে। শ্রমিকদের জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা, পর্যাপ্ত পানি ও সাবান রাখা, প্রয়োজনে গরম পানি সরবরাহের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সংগঠনের উত্তরা অফিসে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় খোলা হয়েছে ‘বিজিএমইএ-করোনা কন্ট্রোল রুম’। বিজিএমইএ ১১টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র কারখানাগুলোকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে।
তথ্যমতে, বিজিএমইএর সদস্য ১৭১ কারখানার ৩৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও আছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক প্রাইমার্কের পাশাপাশি ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করেছে ইউরোপের ছোট-মাঝারি-বড় সব ধরনের ক্রেতাই।
বিজিএমইএ পিরিচালক মুহিউদ্দিন রবেল বলেন, বাতিলের সংখ্যাটা কম বেশি হতে পারে। কারণ প্রতি মুহুর্তে তথ্য আপডেট হচ্ছে।
বিপর্যয়-পরবর্তী চাহিদা ও সরবরাহের অসামঞ্জস্যতার প্রেক্ষাপটে প্রায় ৩০ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পোশাক শিল্পের বড় উদ্যোক্তারা।