জেগে উঠুক মনুষ্যত্ব

একটা সময় ছিল যখন আমি ছিলাম নিজ পরিবার এবং প্রতিবেশীদের হাঁস-মুরগি জবাই করার প্রধান ভরসা। ছাগলও জবাই করেছি। ধর্মীয় অনুশাসন মেনেই করেছি।

আমার প্রবাস জীবনের সহকর্মীরা রক্তে ভয় পায়। নিজেরা কোনো কিছু জবাই করতে পছন্দ করে না। বাজারে জবাই করা পরিচ্ছন্ন হাঁস-মুরগির মাংস কেনে। আমার দীর্ঘদিনের সহাবস্থানের জন্য তাদের অভ্যাসটাই রপ্ত করতে হয়েছে। অভ্যাসের দীর্ঘ যাত্রায় আমার সুপ্ত মনেও যে রক্ত ভীতি জন্মেছে সেটা বুঝলাম যখন আমার ভাতিজির বিয়ের ভিডিওতে গরু জবাইয়ের দৃশ্যে আঁতকে উঠে চোখ সরালাম।

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সুপ্ত আরো একটি মানুষ বাস করে। কখনো কখনো সে হয়তো নিজেও জানে না সে কী করছে কিসের জন্য করছে? বিশ্বজিতের হত্যাকারী এক যুবক বলেছিল—গুলি করে মানুষ মারতে তার ভালো লাগে না। ছুরি চাকু দিয়ে আঘাত করতে সে পছন্দ করে। রক্ত দেখলে মজা পায়। জানি না কোন পরিবেশে সে বেড়ে উঠেছে, কাদের সঙ্গে সে সময় কাটিয়েছে।

আমাদের ককটেল আধুনিকায়ন হয়ে পেট্রোল বোমায় পৌঁছেছে। পেট্রোল বোমায় গাড়ি পুড়ছে, বাড়ি পুড়ছে, মানুষ পুড়ছে, পুড়ছে গবাদিপশুও। টেলিভিশন খুললেই দেখি ভুক্তভোগী মানুষের আহাজারি। আর পর্দার আড়ালে হয়তো এই হামলাকারীরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে।

আমার প্রসঙ্গ এই হরতাল বা রাজনীতি নিয়ে নয়। আমি এই ক্ষুদ্র মানুষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেও আমাদের এই রাজার নীতি বুঝি না বলেই রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করি। আমার প্রসঙ্গ মূলত মানুষের মানবিক গুণাবলি। যারা এই ঘৃণ্যতম হামলা করছে তারাও তো মানুষ। জন্ম নিয়েছে কোনো মায়ের পেটে। তাদেরও পরিবার আছে। ছোটবেলা হাত-পা নেড়ে বলেনি—আমি বোমা হামলাকারী হবো, আমি সন্ত্রাসী হবো। বড় হতে হতে তার চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে এখন সন্ত্রাসী বানিয়েছে। হয়তো প্রতিদিন চোখ খুলে সে দেখেছে অশান্তির এক পরিবেশ। টিভি খুলেই দেখছে অত্যাধুনিক হামলার স্টাইল। মা-বাবার হয়তো সময় নেই সন্তানের কোনো খোঁজ নেবার। অথবা দারিদ্র্যের কষাঘাতে বেড়ে ওঠা শিশুটির কাছে জীবন-মৃত্যু ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য বোঝার সুযোগ হয়নি। অর্থের লোভেই হয়তো বেছে নিচ্ছে অপরাধের কৌশল। আবার কারো আনুগত্য পাবার জন্য বা নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্যই পা বাড়াচ্ছে অপরাধ জগতে। আরো একটি শ্রেণি আছে যাদের পরিবারের কাছেই অপরাধের হাতেখড়ি হয়, উত্তরাধিকার সূত্রেই তারা অপরাধ জগতের খেলোয়াড়। এই শ্রেণির জন্য আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কিন্তু বাকি অংশের অধিকাংশই হয়তো তাদের এই অপরাধী জীবন স্বেচ্ছায় গড়ে তোলেনি বা এই জীবনকে ভীষণ ভালোবাসে এমনটি নয়। পরিস্থিতি তাকে অপরাধী করে তুলেছে। সে ঘৃণা করে নিজের এই অপরাধী জীবনকে। কেউ একটু সহযোগিতার হাত বাড়ালেই হয়তো ফিরে আসবে স্বাভাবিক জীবনে।

ষোল কোটি মানুষের এই দেশে সন্ত্রাসীর সংখ্যা কি খুব বেশি? অবশ্যই নয়। আমরা যদি পারিবারিক এবং সামাজিক ভাবে ভালোকে গ্রহণ করতে জানি এবং ভালো গড়তে শুরু করি তাহলে এই খারাপ বিদায় নিতে বাধ্য।

একটি শিশুর প্রথম শিক্ষার জায়গা তার পরিবার। সেখানে যদি সে উপযুক্ত পরিবেশ পায় তাহলে বিপথগামী হবার সম্ভাবনা খুবই কম। আপনি যদি পিতা মাতা হন বা বড় ভাই বোন হন—দিনে অন্তত দশটি মিনিট আপনার সন্তানের বা ভাইবোনের খোঁজখবর নেবার জন্য ব্যয় করুন। জানতে চেষ্টা করুন—সে কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মেশে, কী পছন্দ করে, টিভিতে কী দেখে, তার অর্থনৈতিক চাহিদা কেমন ইত্যাদি। শুধু বীজ বপন করলেই হবে না, পরিচর্যা আর যত্নে বড় করলেই পাবেন ভালো ফল নতুবা হতে পারে আগাছা।

পরবর্তী মানুষ গড়ার কারখানা স্কুল। গতানুগতিক শিক্ষার পাশাপাশি মনুষ্যত্ব বিকাশের কোনো শিক্ষা আমাদের নেই বললেই চলে। একজন শিক্ষক পেশাগত দায়িত্ব ছাড়াও একজন মানুষ হিসেবে যে দায়িত্ব আছে সেটা মনে রাখলে বিপথগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আমাদের হাতে গুনতে হবে।

আমাদের সকলের ব্যক্তিগত জীবনের নিজস্ব কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি মানুষ হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব আছে এই মানব সমাজের জন্য সেই দায়িত্ব থেকে আমরা যদি হাত বাড়িয়ে দেই আমাদের শিশুদের দিকে—তাদের মানবিক গুণ বিকাশ পেতে বাধ্য। তার আগে জাগাতে হবে আমাদের মনুষ্য আত্মা।