
- স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে প্রায় সব দেশ
- এক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা বৈশ্বিক জিডিপিতে
- মন্দার কবলে পড়তে পারে বাংলাদেশও
- বাণিজ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জরুরী বৈঠক
স্টাফ রিপোর্টার: “নভেল করোনা ভাইরাস”। এখন আর চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ। ছড়িয়েছে এশিয়া মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের একশ’রও বেশি দেশ ও অঞ্চলে। এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যে এক লাখ ৮ হাজার ছাড়িয়েছে। এই ভাইরাসে বিশ্বের প্রায় সব দেশই মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির কবলে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এর আগে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক কোন সঙ্কটই বিশ্বজুড়ে এতটা আতঙ্ক সৃষ্টি করেনি, যতটা করোনার ধাক্কায় কাঁপছে গোটা বিশ্ব। ধারণা করা হচ্ছে করোনা ধাক্কায় এক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বৈশ্বিক জিডিপি। এখনও চীনের সঙ্গে কোন দেশেরই আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক হয়নি। ভাল নেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালির অর্থনীতি। দেশগুলোতে ইতোমধ্যেই অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের অর্থনীতিও ভারসাম্য হারাতে বসেছে। একই অবস্থা ইন্দোনেশিয়া ও জাপানেও। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত হতে পারে বাংলাদেশও। বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল আমদানি সঙ্কটে দেশের ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। দেশের বাণিজ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেবেন দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলমান এ স্বাস্থ্য সঙ্কটে এক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বৈশ্বিক জিডিপি। কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, উৎপাদন হ্রাস, সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য কমে যাওয়ায় এ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীরাও উদ্বিগ্ন। অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স আরও বলছে, ইতোমধ্যে করোনার ‘শীতল প্রভাব’ পড়তে শুরু করেছে। কারণ চীনের কারখানা বন্ধের প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পণ্যের উপকরণ এবং তৈরি পণ্য এসব দেশ থেকে সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। করোনার কারণে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার গত বছরের ৬ শতাংশ থেকে কমে এবার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব বলছে, ভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস পেয়ে শূন্য দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়াবে। সম্প্রতি আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোবিন্দ এক বিবৃতিতে বলেন, মহামারী ঘোষণার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি সত্যিকার অর্থে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সমিতি (আইএটিএ) জানিয়েছে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে করোনা ভাইরাসের কারণে এবার দুই হাজার ৯৩০ কোটি ডলার ক্ষতি হবে। এবার বিমান সংস্থাগুলোর যাত্রী ১৩ শতাংশ কমে যাবে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। আইএটিএর সিইও এ্যালেক্সান্দ্রে ডি জুনিয়াক এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিমান সংস্থাগুলোর জন্য এ বছরটি কঠিন যাবে। করোনার কারণে প্রতিদিন ১৩ হাজার ফ্লাইট বাতিল করা হচ্ছে। শুধু চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত সাত বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেবা খাতের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। জানতে চাইলে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, চীন এমন অবস্থান তৈরি করেছে যে, তারা খারাপ থাকলে বিশ্বের কেউ ভাল থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ওই দেশের স্থবিরতা বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এদিকে এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক বার্তা দিয়ে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতি আঁতকে ওঠার মতো পর্যায়ে যেতে বসেছে। সংস্থাটি পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় নিয়েও পরামর্শ দিয়ে বলেছে, যদি করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে যে সঙ্কটের দুর্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সেটি মোকাবেলায় সব প্রজ্ঞাবান মানুষ আত্মনিয়োগ করেন, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ও পরিষেবা দ্রুত নিয়ে আসতে পারেন, একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে আর্তমানবতার সেবায় হাতে হাত রেখে এগিয়ে আসেন, তাহলে এই ভাইরাস বেশিদিন টিকে থাকার কথা নয়।
জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে চীনে উদ্ভূত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া প্রায় সব মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। এখন পর্যন্ত চীনের বাইরে বিশ্বের একশ’রও বেশি দেশে ৩ হাজার ৮২১ জন করোনাআক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। ইতোমধ্যে গোটা বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৮ হাজার ছাড়িয়েছে। এ পর্যন্ত ৩ জন আক্রান্ত হয়েছে বাংলাদেশে। এছাড়া ব্রাজিল, পাকিস্তান, নরওয়ে, গ্রিস, রোমানিয়া, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, নর্থ মেসিডোনিয়া ও আলজিরিয়ায় নতুন করে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।
জানা যায়, মূলত করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে দেশকে সুরক্ষার জন্য আগাম সতর্কতামূলক হুলস্থুল কর্মকাণ্ড ও জনগণকে সতর্ক করতে অতি সতর্ক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ামূলক ফসল হচ্ছে অর্থনৈতিক সঙ্কট। কারণ বিশ্বের বৃহৎ রফতানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য নেই বিশ্বে এমন দেশ নেই বললেই চলে। ফলে অতি সতর্কতার কারণে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, যাতায়াত- এই মুহূর্তে বিশ্বের অনেক দেশেরই বন্ধ রয়েছে। অনেক খাত ধীরে ধীরে বা দ্রুত বন্ধ হতে চলেছে। আকাশপথে বিমান এখন চীনমুখী হচ্ছে না। চীন থেকে পণ্য নেয়ার বিমানও খুব একটা অন্য দেশমুখী উড়ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাজার হাজার বিমান বিশ্বের সবচেয়ে অর্থনৈতিক পরাশক্তির একটি দেশের সঙ্গে যখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখে তাহলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়। সূত্রমতে, এখন চীনের শত শত কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। অনেক কোম্পানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে, আবার লাখ লাখ ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে নিজ দেশে বা অন্য কোন দেশে চলে যাচ্ছে। এতে সংকুচিত হচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিধি আর সরবরাহ ব্যবস্থা। বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করতে বাধ্য হচ্ছে। উহান শহর নিষিদ্ধ থাকায় দেশের অভ্যন্তরেই ব্যাহত হচ্ছে জ্বালানি তেল সরবরাহ।
এদিকে পুরো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে সূচকের দরপতন হচ্ছে। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যান লাখ লাখ চীনা পর্যটক। চীনা পর্যটকদের অন্য দেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় চলতি বছর নিউইয়র্ক আর ক্যালিফোর্নিয়ার লোকসান গুনতে হতে পারে ৫৮০ কোটি ডলার। চীনা পর্যটকরা অন্য যেসব দেশের পর্যটন খাতে অনন্য অবদান রাখেন প্রায় সব দেশকেই এবার গুনতে হবে কঠিন লোকসান। করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীনেও আসতে পারছেন না পর্যটকরা। এরই মধ্যে ধস নামতে শুরু করেছে দেশটির পর্যটন খাতে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ আর এশিয়া চীনাদের দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আমেরিকান এয়ারলাইন্স, ডেল্টা এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স চীনে ফ্লাইট বাতিল করেছে। সিঙ্গাপুর তো চীনের পর্যটক নিষিদ্ধ করার চিন্তাভাবনা করছে।