বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়া

 

এ কে এম শহীদুল হক :
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয় ছিল বিশাল ও সমুদ্রের মতো সীমাহীন বিস্তৃত। বঙ্গবন্ধুর সেই হৃদয়ে ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা ও মমতা। মানুষের জন্য ভালোবাসা। তিনি তাঁর হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে তাঁর পুরো অস্তিত্ব দিয়ে ভালোবেসেছিলেন বাংলাদেশের মানুষকে। বাংলার দরিদ্র, শোষিত, অধিকারবঞ্চিত অসহায় মানুষের করুণ অবস্থা দেখে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন, আবেগপ্রবণ হয়েছিলেন; তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। এ মানুষগুলোকে শোষণ-শাসন থেকে মুক্ত করতে হলে তাদের পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করতে হবে। স্বাধীন করতে হবে। তা না হলে তাদের মুক্তি হবে না। পরাধীন জাতি কখনো স্বাধিকার ও স্বাধীনতার স্বাদ পায় না। এ সত্য বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি সেই লক্ষ্য অর্জনকে সামনে রেখেই রাজনীতি করেছেন। কোনো আর্থিক লোভ, ক্ষমতার লোভ কিংবা জেল-জুলুম বা প্রাণনাশের হুমকিতে তিনি দমে যাননি। তিনি জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের দুঃখী-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূর করে তাদের মুখে হাসি ফোটানো এবং সোনার বাংলা গড়ে তোলা।
১৬ই ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি পরের দিন থেকেই নিজেকে রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত করেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই ছিল না। রাস্তা, সড়ক, কালভার্ট, সেতু, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন তথা যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছিল। ব্যাংকে কোনো টাকা ছিল না। রিজার্ভে সোনা ছিল না। পুলিশ ও সেনাবাহিনী সংগঠিত হয়নি। প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। বঙ্গবন্ধু সরকারকে দেশের পুনর্গঠন কাজে হাত দিতে হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা চালু করতে হয়েছে। ব্যাংক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে তা চালু করতে হয়েছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করাতে হয়েছে। ভারত থেকে এক কোটি শরণার্থী প্রত্যাগমন করলে তাদের বাসস্থান ও খাদ্য সরবরাহ করতে হয়েছে। পঙ্গু ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন করতে হয়েছে। বিদেশ থেকে ঋণ, সাহায্য ও খাদ্য এনে মানুষকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে। তিনি ৯ মাসের মধ্যে বিশ্বের একটি সেরা সংবিধান উপহার দেন। শিক্ষানীতি তৈরি করেন।
বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের অধিকার এবং প্রেস তথা মিডিয়ার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর শাসনামলে সবাই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল। এই সুযোগ ব্যবহার করে স্বাধীনতাবিরোধী ও স্বার্থান্বেষী মহল বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক, অতিরঞ্জিত, পরিকল্পিত গুজব ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের সক্রিয় চেষ্টা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারা সফলও হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে এসে নেতা হয়েছিলেন এমন কিছু তরুণ রাজনীতিবিদ স্বাধীনতাবিরোধী বিদেশি শক্তির মদদে এবং তাদের কাছ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে ভুল পথে চলে গিয়েছিলেন। তাঁরাও বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, মেজর জলিল প্রমুখ। তাঁরা সিরাজুল আলম খানের উপদেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠা করেন। মেজর জলিল পার্টির প্রধান হন। দলের একটি সশস্ত্র উইং ‘গণবাহিনী’ গঠন করেন। গণবাহিনী গোটা দেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে একটা ভীতিকর ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। জাসদের গণবাহিনী ও সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির অস্ত্রধারীরা আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী এবং পাঁচজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করেছিল। থানা, ফাঁড়ি আক্রমণ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করেছিল। পুলিশ হত্যা করেছিল।

এদিকে জনস্বার্থবিরোধী, মুনাফালিপ্সু ব্যক্তি ও অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজ দেশের পাট, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য সামগ্রী ভারতে পাচার এবং অবৈধভাবে মজুদ করে দেশে খাদ্যসংকট সৃষ্টি ও মূল্যবৃদ্ধি করেছিল। সর্বহারা পার্টি, গণবাহিনী ও দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখলেও জনবলস্বল্পতা ও সক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা থাকায় অবৈধ অস্ত্রধারীদের মোকাবেলা করে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা পুলিশের পক্ষে কঠিন ছিল। এমতাবস্থায় রক্ষীবাহিনীকে সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশকে সহায়তা করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। রক্ষীবাহিনী অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, চোরাচালানি ও মজুদদারীদের গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি করেছিল। চোরাচালানি ও মজুদদারী কমেছিল। জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পেতে শুরু করেছিল।
বঙ্গবন্ধু দেখলেন উদার গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী মহল এবং বিদেশি প্রভুদের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে তাদের কাছ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু বিপথগামী নেতা দেশের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীলতা ও অরাজকতা সৃষ্টি করছে। তিনি ভাবলেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাঁকে কঠোর হতে হবে। তিনি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারে ফিরে গেলেন এবং বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করলেন। মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনলেন। বাকশাল ছিল একটি জাতীয় রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। বঙ্গবন্ধু সব রাজনৈতিক দল ও সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের এই প্ল্যাটফর্মে আসার আহ্বান করলেন। ন্যাপ (মোজাফফর) ও সিপিবি বাকশালে এসেছিল। ন্যাপ (ভাসানী) ও জাসদ বাকশালে আসেনি। বঙ্গবন্ধু একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, গোটা জাতি একত্র হয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন করে দারিদ্র্য দূর করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই এই পরিবর্তনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এ ব্যবস্থা সাময়িককালের জন্য। বাকশালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রধান লক্ষ্য ছিল ক্ষেত-খামার ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বৃদ্ধি করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা এবং প্রশাসন ও বিচার বিভাগে সংস্কার আনা।
জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্য কাজ করলে আমার বিশ্বাস ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে চলে যেত। দল-মত-নির্বিশেষে সবার উচিত ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি নবীন দেশকে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা। তাঁর হাতকে শক্তিশালী করে তাঁকে শান্তিতে কাজ করতে দেওয়া, তাঁকে সময় দেওয়া। যদি জাসদ ও সর্বহারা পার্টি সৃষ্টি করে দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি না করা হতো এবং ওই সব নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করতেন, তাহলে দেশের চেহারাই ফিরে যেত। কিন্তু দেশি-বিদেশি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে পড়ে ওই নেতারা ভুল পথে চলেছিলেন।
১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি মহলের মদদে বেইমান মোশতাক নেপথ্যে জিয়ার সমর্থন নিয়ে বিপথগামী কতিপয় সেনা অফিসার দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলার ইতিহাসে যে কলঙ্কময় অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল তার দায় থেকেও কি জাসদ ও সর্বহারা পার্টির নেতারা অব্যাহতি পেতে পারেন? বিশিষ্টজন অনেকেই মনে করেন, তাঁরা এ দায় এড়াতে পারেন না। কারণ দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা নষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।
লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।