
এটিএম রাশেদুল এহসান, এটিভি সংবাদ
শত কোটি টাকা আত্মসাতের মহানায়ক শামসুদ্দোহা চৌধুরী বিপ্লব র্যাবের হাতে আটক। যার আসল নাম এস এম শামসুদ্দোহা চৌধুরী বিপ্লব (৪৫)। তবে তিনি নিজেকে কখনও নেহাল চৌধুরী, কখনও আদিল, অনিক, কায়সার, দোহাসহ বিভিন্ন নামে পরিচয় দিতেন। চাকরির প্রলোভন, সরকারি দফতরে তদবির, বিদেশি প্রজেক্ট দেখিয়ে বিভিন্নজনের কাছ থেকে হাতিয়েছেন শত কোটিরও বেশি টাকা। তার প্রতারণায় সর্বস্বান্ত হয়েছে অসংখ্য মানুষ।
পঞ্চম শ্রেণি পাশ এই ব্যক্তি দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়েছিলেন শ্রমিক হিসেবে। যদিও ভুয়া সার্টিফিকেটের বরাতে নিজেকে পরিচয় দেন বিবিএ পাশ হিসেবে। তবে তিনি ইংরেজি ও কোরিয়ান ভাষায় বেশ দক্ষ। নানা প্রতারণায় অভিযুক্ত এই ব্যক্তি কোরিয়ান রীতিতে নিজের নাম রেখেছেন লি সান হো।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) রাতে রাজধানীর মিরপুর-১ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব-৪ এর একটি দল। বুধবার বিষয়টি জানায় র্যাব-৪
র্যাব-৪ বলছে, বিভিন্ন মানুষের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ নিয়ে লাপাত্তা ও আত্মসাৎ এবং ব্যাংকের চেক জালিয়াতির কারণে আট বার জেলে যান বিপ্লব। ৩৮ মামলার আসামি ও তিন মামলার পরোয়ানাভুক্ত এই ব্যক্তি রাজধানীর বারিধারাতে ছিলেন বহাল তবিয়তে।
এস এম শামসুদ্দোহা চৌধুরী বিপ্লব ওরফে দোহার জন্ম পাবনার চাটমোহর উপজেলার ফৈলজানা গ্রামে।
র্যাব জানায়, ২০-২৫ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকার পর সেখানে প্রতারণায় অভিযুক্ত হয়ে দেশে ফিরে কোরিয়ানদের ট্যুর গাইড হিসাবে কাজ শুরু করেন। ২০১৩-১৪ সালে রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএস এলাকায় খোলেন নামসর্বস্ব ‘WAO’ গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চাকরির প্রলোভন, সরকারি দফতরে তদবির, বিদেশি প্রজেক্ট দেখিয়ে শুরু হয় বিপ্লবের প্রতারণা। অন্যের জমি, খাস জমি দখল করে নিজের নামে ভুয়া দলিল তৈরি করে সেগুলো আবার বিক্রি করে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। তার মালিকানাধীন ডব্লিউসিও (WCO), ডব্লিউএও (WAO), সোলার প্যানেল লিমিটেড ও এঞ্জেল সার্ভিস লিমিটেড নামে চার প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে।
বিপ্লবের রয়েছে একাধিক সহযোগী। প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেন তার তিন স্ত্রী। তার সহযোগীদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দফতরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে বড় বড় প্রকল্পে কাজ দেয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেয়া।
নিত্য-নতুন ভুয়া প্রকল্পের নাম ব্যবহার করে সেখানে অংশীদারিত্ব দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ধনী ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের অর্থ হাতিয়ে নিতো এই চক্রের সদস্যরা। আর নারীদের সঙ্গে অশ্লীল ছবি-ভিডিও ধারণ করে প্রতারণা করত তার তিন স্ত্রী।
বিপ্লব নিজেও কমবয়সী ছাত্রী, স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে সেগুলো দিয়ে ব্ল্যাকমেইল এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মনোরঞ্জনে বাধ্য করতেন। এভাবে তিনি নিজের স্বার্থ হাসিল করতেন। আবার প্রয়োজনে ভুক্তভোগীদের দমাতে করতেন ব্ল্যাকমেইল।
তার পরিচালিত ‘দোহা এঞ্জেল সার্ভিসে’ নারীদেরকে কাজ করতে বাধ্য করা হতো । সরকারি-বেসরকারি বড় বড় প্রকল্পের কাজ পেতে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে বিভিন্ন অফিস এবং প্রতিষ্ঠানে লিঁয়াজো রক্ষা করে চলতেন বিপ্লব।
তার বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার থানায় প্রতারণাসহ ৩৮টি গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে প্রতারণা সংক্রান্ত অসংখ্য জিডি এবং লিখিত অভিযোগ। বিপ্লবের প্রতারণার ভুক্তভোগীদের একজন রাজধানীর জুরাইন এলাকার ইট, বালু, পাথর ও সিমেন্ট ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমার বন্ধুর মাধ্যমে দোহার (বিপ্লব) সঙ্গে পরিচয়। সর্বপ্রথম আমি তাকে পাথর সাপ্লাই করি। পাথরের বিলের জন্য গেলে সে আমাকে ৩১ লাখ টাকার চেক দেয়, সেই চেক আজও পাশ হয়নি। সে আমাকে আরও একাধিক প্রজেক্ট দেখিয়ে রড, সিমেন্ট নেয়। আমাকে সামিট গ্রুপের সঙ্গে এলইডির ৬’শ কোটি টাকার প্রজেক্টের কথা বলে সাপ্লায়ার ও লাভের আশা দেখায় সে। তিন-চারবার চেক নিয়ে ঘোরার পড়ে একপর্যায়ে আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করতে বাধ্য হই।’
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘রড, সিমেন্ট, বালু, পাথরসহ বিভিন্ন সময় তাকে নগদ টাকাও দিয়েছি। সব মিলে এক কোটি ৯১ লাখ টাকার চেক পেয়েছি। আমি শামসুদ্দোহা চৌধুরী বিপ্লবের বিরুদ্ধে এক কোটি ৬০ লাখ টাকার প্রতারণা মামলা করেছি। আমরা ব্যবসায়ীরা একটু লোভী, লোভে পড়ে আমার এত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। বুঝতে পেরে যখন টাকা ফেরত চাইতাম তখন সে রেডিসনে ডেকে নারীদের ব্যবহার করতে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল, বুঝতে পেরে পালিয়ে আসি।’
আরেক ভুক্তভোগী অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তা। তার কাছ থেকে দোহা হাতিয়ে নেন ৮৫ লাখ টাকা।
এ ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘স্ত্রীর বান্ধবীর পরিচিত দোহা। সেই সুবাদে প্লট কেনার প্রস্তাব আসে। জমি কিনতে গিয়ে এক রকম বিশ্বাস করে ৮৫ লাখ টাকা ক্যাশ দেই। ৭ বছর ঘুরে সেই জমি পাইনি। পরে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে বুঝতে পারি ভুয়া দলিল দেখিয়ে প্রতারণা করেছে। সে সব স্বীকার করে ফের প্রতারণা করে। সিটি ব্যাংকের চেক দেয়, যে চেকে ওই ৮৫ লাখ টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এর শেষ দেখতে চাই, র্যাবের ওপর আস্থা রাখছি। এ বিশ্ব-প্রতারকের হাতে যেন আর কোনো মানুষ প্রতারিত না হয়, কোনো বোন যেন ফাঁদে আর না পড়ে।’
এ বিষয়ে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘গ্রেফতার দোহা এসব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। প্রতারিত অসংখ্য ভুক্তভোগী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তাদের মধ্যে ১০-১২ জন প্রতারক দোহার বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। যারা মামলা করতে ইচ্ছুক, র্যাব-৪ তাদের প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা দিতে প্রস্তুত।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার ব্যাংক, নগদ কিংবা পাচার হওয়া টাকার হদিস খতিয়ে দেখতে সিআইডিকে মানিলন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হবে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে প্রত্যেকটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে।’
