
বিশ্লেষকদের অভিমত-
- কারসাজি, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা জড়িত
- পলিসি সাপোর্ট দেয়ার আশ্বাস বাংলাদেশ ব্যাংকের
- বিভিন্ন হাউস থেকে বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি
নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনারভাইরাস আতঙ্কে দেশের শেয়ারবাজারে বড় বিপর্যয় হয়েছে। বুধবার একদিনেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজারমূলধন ১০ হাজার কোটি টাকা কমেছে। আর গত ৭ কার্যদিবসে কমেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
রোববার মূল্যসূচক কমেছে ১৬০ পয়েন্ট। আর এ নিয়ে প্রায় ৭ বছর পর ৪ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে ডিএসইর মূল্যসূচক।
বাজারের এমন পরিস্থিতি অতীতে যে কোনো সময়ের চেয়ে শোচনীয়- এমন মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, শুধু করোনা নয়, নজিরবিহীন এ পতনের পেছনে কারসাজি রয়েছে।
এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা জড়িত। এই কারসাজি চিহ্নিত করে বাজার রক্ষায় সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরও জানা গেছে, করোনায় আরও পতন হবে- এমন আতঙ্কে বিভিন্ন হাউস থেকে রোববার ফোর্সড শেয়ার সেল (বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি) করা হয়েছে। এছাড়া বাজার পরিস্থিতির উন্নয়নে রোববার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
বৈঠকে শেয়ারবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সব ধরনের ‘পলিসি সাপোর্ট (নীতি সহায়তা)’ দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় হয়েছে। এর কারণ হিসেবে একেকজন একেক ধরনের কথা বলছেন। কেউ বলছেন, করোনাভাইরাস আতঙ্ক। আবার কেউ বলছেন, অর্থনীতি খারাপ। তবে আমার বক্তব্য পরিষ্কার। আর তা হল এ ধরনের দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। এই পতনের পেছনে কারা জড়িত সেটি খুঁজে বের করতে হবে।
বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কী করছে, তা তদন্ত করা উচিত। তিনি আরও বলেন, মধ্য মেয়াদে বাজারের উন্নয়নে সুশাসন ও ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এগুলো সময়ের ব্যাপার। বাজারে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। তার মানে এই নয় যে, হঠাৎ করে এই ধরনের পতন হবে।
বাজারের উত্থান-পতন মূল্যসূচক দিয়ে বোঝা যায়। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়লে সূচকের উত্থান আর কমলে পতন হয়। বাজারসংশ্লিষ্টদের এতদিন ধারণা ছিল বড় বিপর্যয় না এলে সূচক কোনোভাবেই ৪ হাজার পয়েন্টের নিচে আসবে না।
এসব কারণেই এই ৪ হাজার পয়েন্টকে ‘মনস্তাত্ত্বিক লেভেল’ বলা হতো। কিন্তু রোববার ওই লেভেল ভেঙে ৩ হাজার ৯৬৯ পয়েন্টে নেমে আসে ডিএসইর সূচক। বাজারের অবস্থা গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর সূচক ৩ হাজার ৭৯২ পয়েন্টে ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রোববারের পতনের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জড়িত। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান আগে বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়েছিল, তারাই পতনের জন্য দায়ী। কারণ তারা করোনা আতঙ্কে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ফোর্সড সেল (বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি) দিচ্ছে।
নিয়ম অনুসারে একজন বিনিয়োগকারী ১০০ টাকা থাকলে মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউস শেয়ার কেনার জন্য তাদের সর্বোচ্চ আরও ৫০ টাকা ঋণ দিতে পারে।
শেয়ারবাজারের পরিভাষায় একে মার্জিন ঋণ বলে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা- সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সর্বশেষ নির্দেশনা অনুসারে এই মার্জিন ঋণের অনুপাত ১:০.৫। কিন্তু বেশকিছু বড় প্রতিষ্ঠান এই সীমা মানেনি।
তারা ১০০ টাকার বিপরীতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে। আর বর্তমানে শেয়ারের দাম কমছে। আরও কমতে পারে এই আশঙ্কায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ফোর্সড সেল করে দিচ্ছে। এতে বাজারে লাগামহীন পতন হচ্ছে।
ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে ৩ মার্চ ডিএসইর বাজারমূলধন ছিল ৩ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। রোববার পর্যন্ত তা কমে ৩ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ হিসেবে ৭ কার্যদিবসে ডিএসইর বাজারমূলধন কমেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর একক দিন হিসেবে রোববার কমেছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
একক দিন হিসেবে রোববার ডিএসইতে ৩৫৫টি কোম্পানির ১৬ কোটি ৯১ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যার মোট মূল্য ৩৭৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
এর মধ্যে দাম বেড়েছে ১০টি কোম্পানির শেয়ারের, কমেছে ৩৩৮টি এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৭টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। ডিএসইর ব্রড সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৬০ পয়েন্ট কমে ৩ হাজার ৯৬৯ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসই-৩০ মূল্যসূচক ৪৮ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩৩৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসই শরীয়াহ সূচক ৩১ পয়েন্ট কমে ৯২৬ পয়েন্টে নেমে এসেছে।
শীর্ষ দশ কোম্পানি : ডিএসইতে রোববার যেসব কোম্পানির শেয়ার বেশি লেনদেন হয়েছে সেগুলো হল- মুন্নু সিরামিক, গ্রামীণফোন লিমিটেড, ওরিয়ন ফার্মা, স্কয়ার ফার্মা, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকে বাংলাদেশ, সামিট পাওয়ার, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, ওরিয়ন ইনফিউশন, ব্র্যাক ব্যাংক এবং ন্যাশনাল টিউবস।
রোববার ডিএসইতে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি বেড়েছে সেগুলো হল- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, মুন্নু সিরামিক, অ্যাপেক্স স্পিনিং, আজিজ পাইপ, মতিন স্পিনিং, গ্রীন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড, বিজিআইসি, সি-পার্ল বিচ, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক।
অন্যদিকে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি কমেছে সেগুলো হচ্ছে- অ্যাপোলো ইস্পাত, প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, আইডিএলসি, শ্যামপুর সুগার মিল, অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, জিল বাংলা সুগার মিল, মেঘনা সিমেন্ট, সোনারগাঁ টেক্সটাইল, সমতা লেদার এবং মেট্রো স্পিনিং।
আমাদের ফেসবুক পেইজ
https://m.facebook.com/b2bnews