অনুসন্ধানী প্রতিবেদক, এটিভি সংবাদ
কুড়িগ্রামে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির তালিকায় সচ্ছল ও স্বজনদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এজন্য ব্যবস্থা করা হয় আলাদা সিমের। অতিদরিদ্ররা টাকা দিতে না পারলে সচ্ছলদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে এই তালিকায় নামভুক্ত করা হয়। নাম তালিকায় উঠলেও তাদের অনেকের হাতে ওঠে না কোদাল; মাথায় ওঠে না মাটির ডালি। এছাড়াও চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সচিবদের স্বজনরাও থাকেন এই তালিকায়। যাদের বরাদ্দকৃত টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন তারা। এসব জেনেও নিশ্চুপ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। বারবার অনিয়ম ধরিয়ে দেয়ার পরও মেলেনা কোনো প্রতিকার। ফলে সংবাদকর্মীদের উপর চাপ বেড়ে যায়। এসব অনিয়মে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলে নিউজ না করার জন্য। ফলে সরকারের ভালো উদ্যোগগুলো ভেস্তে যাচ্ছে প্রশাসনের নীরবতা ও এক শ্রেণির জনপ্রতিনিধিদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে।
সরজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের সরকার দলীয় চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামসহ তার পরিষদের মেম্বারদের বিরুদ্ধে উঠেছে একাধিক অভিযোগ। ২০২১-২২ অর্থ বছরে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে মেম্বারদেরকে নিয়ে সাড়ে ৩ শতাধিক হতদরিদ্রের তালিকা করেছেন চেয়ারম্যান নিজে। এরমধ্যে অনিয়ম করা হয়েছে অর্ধশতাধিক নামে। তালিকায় পাওয়া গেছে খোদ ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামের দুই ভাই হাবিবুল ইসলাম ও পল্লী চিকিৎসক মোহাম্মদ আলীর নাম।
৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল কাদেরের ছেলে সাহাজুল আলম ও এনামুল হক, পুত্রবধূ তাহমিনা বেগম ও আদুরি বেগমের নাম। ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার মোকারুল ইসলাম ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা, ছোট ভাই দিনাজপুরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাকারিয়া সরকার এবং ভাতিজা খোরশেদের নাম রেখেছেন এই তালিকায়। যাদের অনেকের মোবাইল সিম ইউনিয়ন সচিব মাহাফুজার রহমান নিজের কাছে রেখে সেই টাকা উত্তোলন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এমন অবৈধ কর্মকাণ্ডে হতবাক ইউনিয়নের দরিদ্র অধিবাসীরা। জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা তালিকায় দেবর ও নিজের নাম থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, মজুরির টাকা কে পায় সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। ইউপি মেম্বার আব্দুল কাদের বলেন, মেম্বারেরও তো খরচ আছে। বিভিন্ন স্থানে খরচ দিতে হয়। খরচের জন্য দু’একটা নাম দেয়া হয়। বাহুবল গ্রামের বাসিন্দা সুবিধাভোগী সরিফা বেগমের স্বামী মোজাম্মেল হক বলেন, আমার স্ত্রীর নাম তালিকায় দেয়া আছে। স্ত্রী অসুস্থ থাকায় আমি নিজে কাজ করেছি। প্রথম দফা ৪০ দিন এবং ২য় দফায় ২০ দিনের কাজ করে ৪শ’ টাকা হারে ৬০ দিনে ২৪ হাজার টাকা পেয়েছি।
ইউনিয়ন আনছার ভিডিপি’র কমান্ডার মোহাম্মদ আলী ভোলা বলেন, তালিকায় চেয়ারম্যানের ভাই, ভাতিজা ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার, ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বারের ছেলে ও পুত্রবধূর নামসহ ইউনিয়ন সচিবের ঘনিষ্টজনদের নাম রয়েছে। অথচ এলাকার অনেক হতদরিদ্রদের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। রুহুল আমিন নামে একজন গ্রামবাসী জানান, ৪০ দিনের কর্মসূচি এবং ভিজিএফ’র তালিকা জনপ্রতিনিধিরা টাকার বিনিময়ে করে থাকে। যারা টাকা দিতে পারে না তাদেরকে বাদ দেয়া হয়। এখানে ধনী-গরিব দেখা হয় না। এ ব্যাপারে নুনখাওয়া ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বিধি মোতাবেক ৬০ বছরের উর্ধ্বে তাদের নাম নেয়া যায় না। তাই কিছু শ্রমিকের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এমনটি হয়েছে বলে তিনি বিষয়টি পাশ কাটান।
বিষয়টি নিয়ে নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আহমেদ মাছুম জানান, তালিকা প্রিন্ট করে ইউনিয়নের ডোর টু ডোর তালিকা যাচাই করা হচ্ছে। তালিকায় কতগুলো এমন অসংগতি রয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পেলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। কুড়িগ্রাম জেলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯টি উপজেলায় ২৭ হাজার ৯২৮ জন সুবিধাভোগীর জন্য ৪৪ কোটি ৬৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকাসহ নন-ওয়েজ কষ্ট খাতে ২ কোটি ৫ লাখ ১৫ হাজার ১০১ টাকা এবং শ্রমিক সর্দার ভাতা বাবদ ১৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
উপজেলাভিত্তিক সুবিধাভোগীর মধ্যে ভূরুঙ্গামারীতে ৩ হাজার ৪৩২ জন, নাগেশ্বরীতে ৪ হাজার ৯৪৯ জন, ফুলবাড়ীতে ২ হাজার ৩৬০ জন, কুড়িগ্রাম সদরে ৩ হাজার ৫০১ জন, রাজারহাটে ২ হাজার ৬৩১ জন, উলিপুরে ৫ হাজার ৭১ জন, রৌমারীতে ২ হাজার ৯৩১ জন, চিলমারীতে ১ হাজার ৮৫২ জন এবং চর রাজিপুরে ১ হাজার ২০১ জন।