নিজস্ব প্রতিনিধি, এটিভি সংবাদ
বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা চলছে। এই উদ্যোগ নিচ্ছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সাংগঠনিকভাবে দলকে গতিশীল, শক্তিশালী ও আন্দোলনের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনের আগে আর ক্ষমতা পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছেন না বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।
ফলে আগামী সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করেই পরিকল্পনা গ্রহণে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে কথা বলছে শীর্ষ নেতৃত্ব। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সূত্রগুলো বলছে, দীর্মমেয়াদি পরিকল্পনার শুরুতে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করতে চায় বিএনপি। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে কাদের দায়িত্ব দেওয়া যায় সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
এই দুই পদে বেশ কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতার নাম শোনা যাচ্ছে।
এর বাইরে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতেও নতুন কিছু মুখ আসতে পারে। সেখানেও কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা স্থান পেতে পারেন। তবে দলের মহাসচিব পরিবর্তন নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন থাকলেও বাস্তবে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
দলের এসব পরিবর্তন জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে হবে, নাকি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রে দেওয়া ক্ষমতাবলে করবেন তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে কাউন্সিল ছাড়াই নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পক্ষেও জোরালো মত আছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে স্বাভাবিকভাবেই অনেক নতুন মুখ আসবে। এটি স্বাভাবিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অংশ। তবে কাউন্সিল নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিল করা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। ফলে কাউন্সিল ছাড়াই দলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পক্ষে মত দিচ্ছেন অনেক নেতা। এ ধরনের মতামত যাঁরা দিচ্ছেন তাঁদের সবাই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, কাউন্সিল ঘিরে সরকার নানা ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এ কারণে দলের প্রধান দুই নেতার অনুপস্থিতিতে কাউন্সিল করার মতো বিশাল সাংগঠনিক কর্মযজ্ঞ না করাই উত্তম।
কয়েক মাস আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সভায় কাউন্সিল করা উচিত বলে মত দেন কয়েকজন নেতা। এ নিয়ে পরে অন্য কোনো বৈঠকে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত থাকলেও সে আলোচনা আর হয়নি।
গুরুত্বপূর্ণ পদে যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে
সাংগঠনিক পর্যায়ে বিএনপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। এ পদে দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তিরা সাংগঠনিক জেলা, মহানগর, উপজেলা/থানা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্বাচিত করার বিষয়ে কাজ করেন। এ পদে সাবেক ছাত্রনেতাদের দায়িত্ব দিতে দলের জেলা ও মহানগর কমিটির নেতারা প্রস্তাব করেছিলেন। তৃণমূল নেতাদের মতামতের ভিত্তিতেই এবার নতুন কমিটিতে এর প্রতিফলন দেখা যেতে পারে।
দলের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলের নাম আলোচনায় আছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে সাবেক ছাত্রনেতা বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের নাম শোনা যাচ্ছে। রাজশাহী বিভাগীয় সংগঠনিক সম্পাদক পদে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনায় আজিজুল বারী হেলাল, বরিশালে এ বি এম মোশাররফ হোসেন, সিলেটে জি কে গউছ, ফরিদপুরে শহিদুল ইসলাম বাবুল, রংপুরে আবদুল খালেক ও ময়মনসিংহে শরিফুল আলমের নাম আলোচনায় আছে। কুমিল্লায় সম্প্রতি সেলিম ভূঁইয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
যুগ্ম মহাসচিব পদে আলোচনায় আছেন আসাদুল হাবিব দুলু, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, রকিবুল ইসলাম বকুল প্রমুখ।
দলীয় সূত্র জানায়, আন্দোলন-পরবর্তী বিভিন্ন সাংগঠনিক প্রতিবেদনে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছেন, দলের প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, এমন নেতারা গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য নিশ্চয়ই শীর্ষ নেতৃত্বের ভাবনায় আছেন।’
মহাসচিব নিয়ে কী হচ্ছে
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আর এ পদে থাকবেন কি না, এ নিয়ে বিএনপি নেতাদের একাংশ আলোচনা তোলেন। তিনি পদত্যাগ করছেন বলেও গুঞ্জন তৈরি করা হয়। তবে অনেকে মনে করছেন, পরিকল্পিতভাবে এ গুঞ্জন তৈরি করা হয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মহাসচিবের দ্বিমত আছে বলে আলোচনা রয়েছে। বিষয়টিকে পুঁজি করে নেতাদের একাংশ মহাসচিব পদে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি সামনে আনেন। নতুন মহাসচিব পদে সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদের নাম। প্রায় ৯ বছর ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করা সালাহ উদ্দিন আহমেদ কতটা সাবলীলভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তা নিয়েও নানা ধরনের প্রশ্ন আছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলের নেতাকর্মীদের বড় অংশ মনে করেন, মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনার মতো বাস্তবতা বর্তমানে বিএনপিতে নেই। এখন এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে দল জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের জীবদ্দশায় তাঁর মতামতের বাইরে কাউকে মহাসচিব করা বেশ কঠিন।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কর্তৃত্ব আরো বাড়বে
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কয়েকজন কালের কণ্ঠকে বলেন, যেভাবে সাবেক ছাত্রদল নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনার কথা ভাবা হচ্ছে, তাতে দলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কর্তৃত্ব আরো বাড়বে। দলে তাঁর বড় বলয় তৈরি হবে। দলের নেতাদের কেউ কেউ পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিলে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁদের ধারণা, সামনে বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে সরকারি মহল নানা ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এ কারণে গঠণতন্ত্রে তাঁকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়ার পরও আরো কিছু ধারা সংযোজন করা হতে পারে।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখেন এমন একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিডিয়াকে বলেন, বিএনপি কী করবে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। দলের নেতাকর্মীদের সামনে কোনো ভিশন নেই। ফলে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে হাত দেওয়ার আগে কর্মপন্থা তৈরি করা উচিত। কোন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলব, কূটনৈতিক তৎপরতা কিভাবে এগোবে—এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এ ছাড়া দেশের রাজনীতিতে ডান-বাম সমন্বিত সরকারবিরোধী একটি জোট কিভাবে গড়ে তোলা যায় সে বিষয়েও বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। এসব ঠিক না করে শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তন করলে তা তেমন সুফল বয়ে আনবে না।