খুলনা প্রতিবেদক, এটিভি সংবাদ
চিকিৎসা চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে খুলনায় বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল-ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারও। তবে দালালদের খপ্পরে পড়ে এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা অসংখ্য মানুষ। কিন্তু এর যেন কোনো প্রতিকার নেই। সচেতন নাগরিক কমিটির নেতারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতাই এর কারণ।
অপর্যাপ্ত চিকিৎসক ও মানহীন বেসরকারি এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হলেও জরিমানাতেই সীমাবদ্ধ থাকে তা।
দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কেন্দ্র করে এর আশপাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। স্থানীয়দের অভিযোগ, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দালালদের মাধ্যমে রোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে চলছে চিকিৎসা বাণিজ্য।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, খুলনা নগরীতে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ২৫০টি। এর মধ্যে ২০২২-’২৩ অর্থবছরে নবায়ন করেনি ১৩২টি প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে কমিশন পাচ্ছে দালাল চক্র। তবে এদের বিরুদ্ধে র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও থেমে নেই দালাল চক্র। এদের যারা লালন করে সেসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মহানগরী ও আশপাশের উপজেলায় রয়েছে অগণিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল। দেখা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়মনীতি মানছে না এসব প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন সকালে খুলনা মেডিকেলের বহির্বিভাগ থেকে শুরু করে ভেতরে ভর্তি রোগীদের সামনে দেখা যায় দালালদের আনাগোনা। তবে বেশি চোখে পড়ে মহিলা দালালের সংখ্যা।
বাগেরহাটের সদর উপজেলার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। তবে দালালদের খপ্পরে পড়ে বেসরকারি একটি ক্লিনিকে গিয়ে হয়েছেন প্রতারণার শিকার।
আলমগীর হোসেন বলেন, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে সময় একজন নারী তাকে ১০০ টাকার বিনিময়ে এর থেকে বড় ডাক্তারের চিকিৎসা দেয়ার কথা বলে হাসপাতালের সামনে বেসরকারি একটা ক্লিনিকে নিয়ে যান। এরপর সেখানে একজন চিকিৎসক তার স্ত্রীকে দেখে কয়েকটি পরীক্ষা দেন। সেই নারী তাকে সঙ্গে করে পাশের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। সেখানে তার কাছে ৪ হাজার টাকা বিল করা হয়।
পরে তিনি বাগেরহাট গিয়ে একজন চিকিৎসক দেখিয়ে জানতে পারেন, তার স্ত্রীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে এ ধরনের পরীক্ষা বা ওষুধের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি আবার খুলনা মেডিকেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। তার স্ত্রী এখন হাসপাতালে ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডে ভর্তি। তিনি বলেন, দালালের কারণে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আর সময়ক্ষেপণে তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত।
নগরীর বাস্তুহারা এলাকা থেকে চিকিৎসার জন্য এসেছেন সুলতানা আক্তার। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসতেই এক নারী তাকে ভালো চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে হাসপাতালের সামনের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় পথে এই প্রতিবেদকের প্রশ্নে সুলতানাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় দালাল চক্রের ওই সদস্য।
সুলতানা আক্তার বলেন, ‘আমি এই প্রথম খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছি। এখানে এসে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই নারী আমাকে এর থেকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে দেয়ার কথা বলে নিয়ে যাচ্ছিল।’
খুলনা টুটপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাহফুজা আক্তার বলেন, এর আগেও খুলনা মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য এসেছি। এখানে আনসার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সামনেই দালালরা ঘোরাফেরা করে। প্রতিটি চেম্বারের সামনে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধিরা বসে থাকেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরাই বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য চেম্বারের সামনে বসে থাকা লোকদের সাথে যেতে বলেন। চিকিৎসক যেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান তার বাইরে অন্য কোনস্থান থেকে পরীক্ষা করালে তারা দেখতে চান না। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের তাদের রেফার করা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করাতে হয়।
খুলনা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. সাদিয়া মনোয়ারা উষা বলেন, বিধি অনুযায়ী প্রতিটি ১০ শয্যা ক্লিনিকের জন্য নির্ধারিত ৩ জন ডাক্তার, ডিপ্লোমাধারী ২ জন নার্স ও ৩ জন সুইপার থাকা বাঞ্ছনীয়। একই সাথে ৮শ’ বর্গফুট জায়গা, সার্বক্ষণিক একজন ডাক্তার, নার্স ও সুইপার থাকতে হবে।
অন্যদিকে প্যাথলজি বিভাগ চালু করতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিপ্লোমাধারী প্যাথলজিস্ট ও ১ জন সুইপার রাখার বিধান। আর মাইক্রোস্কোপ, ফ্রিজ, মেডিকেল যন্ত্রপাতি, অপারেশন থিয়েটার ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
অথচ অধিকাংশ ক্লিনিকে নির্ধারিত ডাক্তার নেই। তারা চুক্তি অনুযায়ী ডাক্তার ডেকে রোগীর অপারেশন বা অন্যান্য চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। সুন্দরবন ক্লিনিকের সামনে একাধিক চিকিৎসকের সাইন বোর্ড রয়েছে। আর চিকিৎসকের ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহার করা হয়েছে। ক্লিনিকের মালিককে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম করায় মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ ধারা-২৯ মোতাবেক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।
খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি কুদরত-ই-খুদা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতায় সক্রিয় মানহীন এসব প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে চিকিৎসা সেবা বড় বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। এদের মনিটরিং করতে ব্যর্থ খুলনার স্বাস্থ্য বিভাগ। বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রভাবিত হচ্ছেন।
এদের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে মনিটরিং করে এবং তালিকা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া অধিকাংশ চিকিৎসক একাধিক ক্লিনিকে চুক্তিবদ্ধ। তাই ঠিকমতো সেবাও দিতে পারেন না। রোগীদের সংকটকালীন ডাক্তার পাওয়া যায় না। অনেকে ক্লিনিক ব্যবসার সঙ্গে ডায়াগনস্টিক ব্যবসা জমজমাট করে তুলেছেন। এক্ষেত্রে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষের হয়রানির শেষ নেই।
এদিকে, অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ। তিনি বলেন, ‘খুলনার ৯ উপজেলায় ১৪৯ টি নিবন্ধিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। আমাদের মনিটরিং টিম মাঠে কাজ করছে। কোনো প্রকার অনিয়মের প্রমাণ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এর আগেও আমরা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছি। তাদের জরিমানা করা হয়েছে। চিকিৎসা সেবা নিয়ে কোনো প্রকার অনিয়মের সুযোগ নেই।’
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ বলেন, আমরা অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত রেখেছি। জনবল সংকট থাকার কারণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া নিজস্ব নির্বাহী ক্ষমতা না থাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে না পারার কথাও জানান তিনি।