টানা বৃষ্টির মধ্যে গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকায় একটি পাহাড় ধসে মাইক্রোবাসের ওপর পড়ে। এই দুর্ঘটনায় সকাল ৭টা থেকে চার ঘণ্টা টাইগার পাস থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ থাকে। বৃষ্টিতে নগরের অনেক স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষকে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়।
বেঁচে যাওয়া মাইক্রোবাসের চালক জীবন বলেন, ‘সকালে গাড়ি নিয়ে বহদ্দারহাটের দিকে যাওয়ার পথে হঠাৎ পাহাড় ভেঙে মাটি আছড়ে পড়ে গাড়ির ওপর। আমি গাড়ি থেকে ছিটকে পড়লে প্রাণে রক্ষা পাই।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের হিসাবে, ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ১৬ বছরে চট্টগ্রাম মহানগর এবং আশপাশের এলাকায় পাহাড়ধসে ২৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে; আহত হয়েছে অনেকেই। পাহাড় কাটার অভিযোগে জড়িতদের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় ২০২২ সালে ২০টি এবং ২০২১ সালে ছয়টি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
এত হতাহতের পরও চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন ও বসবাস বন্ধ করা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বর্ষার আগে-পরে অভিযান চালাই। ১০ দিন আগেও অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয় সেটির ধারাবাহিকতা থাকে না। ফলে অভিযুক্তরা জামিনে চলে এসে একই কাজ করে।’
অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা
রাতভর টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীর অনেক প্রধান সড়ক, গলি ও নিচু এলাকার বাসাবাড়ি, দোকানপাট তলিয়ে যায়। বৃষ্টির পানি উঁচু এলাকা থেকে খাল ও নালা দিয়ে বের হতে না পারায় এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এর সঙ্গে একই সময়ে যোগ হয় সাগর থেকে আসা ব্যাপক জোয়ারের পানি। সব মিলিয়ে গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টা নগরীর বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে ছিল। সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় বেশির ভাগ এলাকার মানুষ ঘর থেকে বের হয়নি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বহদ্দারহাটের নিজ বাসভবনও হাঁটু সমান পানিতে তলিয়ে যায়। মেয়র এ সময় বাসায় আটকা পড়েন। তাঁর গাড়িও জলাবদ্ধতার কারণে বের হতে পারেনি।
অভিযোগ উঠেছে, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) খাল ও নালার মধ্যে থাকা মাটি অপসারণ না করায় জলাবদ্ধতা ব্যাপক আকার ধারণ করে। একই সঙ্গে এই প্রকল্পে ধীরগতির কারণে এখনো খালগুলোর মুখে স্লুইস গেট বা জলকপাট চালু করা যায়নি। এতে বৃষ্টির পানির সঙ্গে জোয়ারের পানি যোগ হয়ে জলাবদ্ধতা দীর্ঘায়িত হয়।
জানা গেছে, শ্রাবণ মাসে গত বুধবার পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরে তেমন বৃষ্টির দেখা মেলেনি। দেশের অনেক স্থানে কিছুটা বৃষ্টি থাকলেও চট্টগ্রামে এর দেখা না মেলায় অসহনীয় দাবদাহে পোড়ে নগরবাসী। তবে দুই দিন হালকা বৃষ্টিপাতের পর বৃহস্পতিবার রাতভর টানা বৃষ্টি হয়। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিল। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে শুরু হয় জোয়ার। এতে পানিতে আটকা পড়ে নগরবাসী।
রাতভর বৃষ্টিতে নগরীর বহদ্দারহাট, শুলকবহর, মুরাদপুর, কাপাসগোলা, চকবাজার, বাকলিয়ার বিভিন্ন এলাকা, ফিরিঙ্গিবাজারের একাংশ, কাতালগঞ্জ, চান্দগাঁওয়ের শমসেরপাড়া, ফরিদারপাড়া, আগ্রাবাদের শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, রিয়াজউদ্দিন বাজার এবং হালিশহরের বিভিন্ন এলাকার সড়ক ও অলিগলি পানিতে তলিয়ে যায়।
শুলকবহরের বাসিন্দা ব্যাংকার আবিদুর রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি বাসার নিচে পানি। দরজা খুলতেই সব পানি ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে যায়। ভারি বৃষ্টি ছিল, কিন্তু এত পানি হবে চিন্তাই করিনি। ভাগ্যিস বন্ধের দিন ছিল বলে বেঁচে গেছি।’
নগরীর চান্দগাঁও, চকবাজার, ষোলশহর এলাকার কাউন্সিলরদের অভিযোগ, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে খাল খনন শেষ হয়েছে। দুই পাশে দেয়াল নির্মাণও শেষ। কিন্তু খালে থাকা মাটি, ময়লা অপসারণ শেষ হয়নি। প্রকল্প কর্মকর্তারা যদি একটি একটি এলাকা ধরে কাজ শেষ করতেন তাহলে নগরবাসী এই জলাবদ্ধতায় পড়ত না। তাঁরা সবখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাজ করছেন। ফলে নগরবাসীর দুর্ভোগ কখন শেষ হবে তা কেউ জানে না।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা আবুল হাশেম বলেন, ‘চাক্তাই খাল হচ্ছে শহরের প্রধান খাল। এই খালে দেয়াল নির্মিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে স্লুইস গেটও। কিন্তু খালের মাটি পুরোপুরি অপসারণ করা হয়নি। এখানে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করছে সিডিএ। বর্ষার আগে মাটি নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা বারবার বলেছি। কিন্তু সিডিএ সেটা না করায় শহর আবার পানিতে ডুবেছে। অথচ এবার জলাবদ্ধতা কম হবে বলে আমাদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল।’
এটিভি/এস