প্রিন্ট এর তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪, ১০:৪৯ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ আগস্ট ১১, ২০২৩, ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ
তুর্কিরা হুররম সুলতানকে যেভাবে স্মরণ করে
নিউজ ডেস্ক, এটিভি সংবাদ
তুর্কি ইতিহাসে হুররম সুলতান একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিনি ছিলেন সুলতান সুলাইমানের স্ত্রী এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের একজন। যিনি কিশোর বয়সে প্রাসাদে দাসি হিসেবে প্রবেশ করলেও ধীরে ধীরে সর্বত্র প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন।
কেমন ছিলেন হুররম সুলতান
প্রশ্ন হলো, হুররম সুলতান ব্যক্তি হিসেবে কেমন ছিলেন? তিনি কি ক্ষমতালিপ্সু ও প্রসাদ ষড়যন্ত্রকারী কোনো নারী ছিলেন, যিনি নিজের রূপের মোহ দিয়ে সুলতান সুলাইমানকে বিভ্রান্ত করেছিলেন, নাকি তিনি ছিলেন একজন প্রভাবশালী সুলতানের যোগ্য স্ত্রী, যিনি গুণ ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
ইতিহাস গবেষক ড. রাগিব সারজানি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন পুণ্যবান নারী ছিলেন। না জেনে তাঁর ব্যাপারে কোনো বাজে মন্তব্য করা উচিত নয়। তিনি জনকল্যাণমূলক বহু কাজ করেছিলেন।’ আর তুর্কি লেখক ইকরেম বুগরা একেনচি বলেন, ‘এটা সত্য যে সুলাইমান হুররম সুলতানের হাস্যোজ্জ্বল মুখ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিলেন।
তাই বলে হুররম তার উত্তেজক সৌন্দর্য দিয়ে সব কিছু জয় করে নিয়েছিলেন এমন ধারণা করাও ঠিক নয়। তিনি ছিলেন সুলতানের যোগ্য স্ত্রী। সুলতান সুলাইমানের মা বেগম সুলতানা হাফসা মারা যাওয়ার পর হুররমই ছিলেন সুলতানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত নারী সঙ্গী। সুলতানের অনুপস্থিতে তিনি রাজধানী ও প্রসাদের সব খবর সুলতানকে জানাতেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুলতানকে পরামর্শ দিতেন এবং সুলতানের জন্য কবিতা লিখতেন।’
রাজপ্রাসাদে যেভাবে এলেন
হুররম সুলতানের জন্ম তৎকালীন পোল্যান্ড রাজ্যের রুথেনিয়াতে (১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে)। এ জন্য তাঁকে রোক্সেলিনা (রুথেনিয়ার কন্যা) ডাকা হতো। পারিবারিক নাম ছিল আলেকজেন্দ্রা লিয়োস্ক। ক্রিমিয়ান সেনারা ১২ বছর বয়সে তাঁকে বন্দি করে তোপকাপি প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয়। এখানে আসার পর হাস্যোজ্জ্বল চেহারার জন্য নাম রাখা হয় ‘হুররম’ (আনন্দমুখর)।
ক্ষমতায় আরোহণের বছরই (১৫২০ খ্রি.) হুররম সুলতানের সঙ্গে সুলাইমানের পরিচয় হয়। তবে হুররম স্ত্রীর মর্যাদা পান ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের পর। তার গর্ভে সুলতান সুলাইমানের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়। সুলতান সুলাইমানের মা মারা যাওয়ার পর প্রথম স্ত্রী মাহিদেবরান ছেলে মোস্তফাকে নিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। ফলে হুররম সুলতান হেরেমের একক কর্তৃত্বের অধিকারী হন। সুলতান সুলাইমান তাঁকে ‘হাসেকি সুলতান’ বা সুলতানের প্রধান স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন।
মোস্তফার হত্যার জন্য দায়ী?
হুররম সুলতানের ব্যাপারে বড় একটি অভিযোগ হলো তিনি সুলাইমানকে শাহজাদা মোস্তফার হত্যার ব্যাপারে প্ররোচিত করেছিলেন। মোস্তফা ছিল প্রথম স্ত্রী মাহিদেবরানের ছেলে। লেখক ইকরেম বুগরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘শাহজাদা মোস্তফা ছিলেন দাদা প্রথম সেলিমের মতোই সুদর্শন ও সাহসী। সুলতান সুলাইমানের প্রথম সন্তান হিসেবে তিনি সিংহাসন প্রত্যাশী ছিলেন। সুলতান সুলাইমান ৪৬ বছর রাজত্ব করেন। যা মোস্তফাকে ধৈর্যহারা করে তোলে। অন্যদিকে তাঁর মাও ছিলেন প্রাসাদের বাইরে। সুতরাং ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে পিতার বিরুদ্ধে নানা তৎপরতায় যুক্ত করে। ফলে সুলাইমান তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য হন। মূলত শাহজাদা মোস্তফার অধৈর্য ও অসতর্কতাই তাঁর পরিণতির জন্য দায়ী। হুররম সুলতান এই পরিণতিতে খুশি হলেও তিনি এর অণুঘটক ছিলেন না।’
তুর্কিরা যেভাবে স্মরণ করে
তুর্কিরা হুররম সুলতানকে একজন পুণ্যবান নারী ও প্রজাদের সেবিকা হিসেবেই স্মরণ করে। জনসেবায় তিনি ছিলেন খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী জুবাইদার তুল্য। তিনি ইস্তাম্বুলে একটি মসজিদ, দুটি মাদরাসা এবং নারীদের জন্য একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলেন। যা বর্তমানে হাসেকি সুলতান কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। আদ্রিনপোল ও আঙ্কারায় তিনি আরো দুটি মসজিদ নির্মাণ করেন। আয়া সোফিয়ার পাশে মুসল্লিদের অজু-গোসলের জন্য একটি বিশেষ গোসলখানা নির্মাণ করেন। হুররম সুলতান ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমে ‘হাসেকি সুলতান ইমারেত’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মূলত একটি লঙ্গরখানা, যেখান থেকে প্রতিদিন পাঁচ শ অসহায় ব্যক্তিকে খাবার দেওয়া হতো। তিনি এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করেন। ‘হাসেকি সুলতান ইমারেতে’র অধীনে একটি মাদরাসা, একটি মসজিদ, আস্তাবল, সেনাশিবির ও একটি বিশ্রামাগারও পরিচালিত হতো। ফিলিস্তিনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত লঙ্গরখানা এখনো টিকে আছে এবং প্রতিদিন অভুক্ত মানুষ সেখান থেকে খাবার গ্রহণ করছে। মক্কা ও মদিনায় তিনি অনুরূপ একটি লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হাজিদের যাত্রাপথে অসংখ্য বিশ্রামাগার নির্মাণ ও পানির কূপ খনন করেন। ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান এবং তাঁকে সুলাইমানিয়া মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
তথ্যঋণ : ডেইলি সাবাহ, কিসসাতুল ইসলাম ও উইকিপিডিয়া
এটিভি/এস
Copyright © 2023 Atv Sangbad (A Concern of Aparadh Anusondhan Ltd) All rights reserved