বিদেশে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তবে দক্ষ কর্মীর চেয়ে অদক্ষ কর্মীর সংখ্যাই বেশি। কর্মীদের দক্ষ করে তুলতে সারা দেশে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র্র (টিটিসি) তৈরি করছে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। তবে প্রশিক্ষকের অভাব, আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ না হওয়ায় দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারছে না তারা।
বিএমইটির প্রকল্প
বিভিন্ন জেলায় ৩০টি টিটিসি নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় বিএমইটি।
সরেজমিন
৩০টি টিটিসির একটি হলো সুনামগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ২০১৪ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও উদ্বোধন করা হয় ২০২১ সালে। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ারও দুই বছর পর। কেন্দ্রটিতে ১১টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেন্দ্রটিতে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, চিফ ইনস্ট্রাক্টর, সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টরসহ ৪৯টি মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১২ জন কর্মরত রয়েছেন। অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, চিফ ইনস্ট্রাক্টরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদই খালি রয়েছে, যার জন্য একেকজন প্রশিক্ষককে একাধিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। এতে সঠিক প্রশিক্ষণ না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রশিক্ষণার্থীদের। এ ছাড়া প্রশিক্ষণকেন্দ্রের আবাসিক ভবনে নিম্নমানের খাবার ও প্রশিক্ষণ ভাতা কেটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রশিক্ষণার্থীদের।
একই অবস্থা দেখা যায় ঝালকাঠি টিটিসিতে। এই কেন্দ্রে তিন মাসব্যাপী সাতটি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ওয়েল্ডিং, অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিকস, ইলেকট্রিক্যাল, অটোক্যাড, কম্পিউটার ও গার্মেন্ট সেলাইয়ের ওপর এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনতলা এই প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিচালনার জন্য ৪৩ জন প্রশিক্ষকের প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে অধ্যক্ষসহ ১১ জন প্রশিক্ষক রয়েছেন। প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি অফিসের সব ধরনের কাজ করতে হয় প্রশিক্ষকদের। এতে নানা ধরনের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয় তাঁদের।
ঝালকাঠি টিটিসির অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম হোসেন বলেন, ‘ঝালকাঠির প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত। এখানে বর্তমানে জনবলসংকট রয়েছে, যার ফলে অনেক কাজ আমাদের করতে হয়। জনবল নিয়োগ দিলে কোনো সমস্যাই থাকবে না। আগামী দিনে আরো ট্রেড বাড়ানো হবে।’
এই দুটি কেন্দ্র ছাড়াও আরো অনেক কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ঠিকমতো ক্লাস না হওয়া, প্রধান প্রশিক্ষকসহ দায়িত্বশীলদের কেন্দ্রে না আসা, ইচ্ছামাফিক ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া এবং কেন্দ্রে এসে প্রশিক্ষণার্থীদের ঘুরে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদন
আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে টিটিসিগুলোর অনিয়ম। নতুন ১৮টি টিটিসির এক হাজার ৮০ জনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আইএমইডি। সংগৃহীত তথ্য না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকার ও অনুমিত তথ্যের ভিত্তিতে ফলাফল তৈরি করা হয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, টিটিসিগুলোতে প্রতিটি বিষয়ের জন্য দুজন প্রধান প্রশিক্ষক ও চারজন প্রশিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু কোনো কেন্দ্রেই পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষক নেই। ফলে যাঁরা দায়িত্বে আছেন তাঁদের অতিরিক্ত চাপ নিতে হচ্ছে। এতে শিক্ষার গুণগত মান ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া ল্যাব থাকলেও পরিদর্শক পদে কোনো লোকবল নেই। আর যাঁরা প্রশিক্ষক হিসেবে আছেন তাঁদের অনেক পদ আবার রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে প্রশিক্ষকদের মধ্যেও রয়েছে চাকরির অনিশ্চয়তা। অতি প্রয়োজনীয় হলেও এসব সেন্টারে নেই কোনো ইন্টারনেট সংযোগ। অথচ অপ্রয়োজনীয় হলেও প্রতিটি টিটিসিতে রাখা হয়েছে ১৪৪ জনের আবাসিক সুবিধা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো আন্তর্জাতিক চাহিদা মেটাতে পারছে না। প্রশিক্ষণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৭ শতাংশ চাহিদা রয়েছে ড্রাইভিংয়ে। কিন্তু সরকারের এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অটোমোটিভ কোর্সে কার্বোরেটর ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু উন্নত দেশ, এমনকি বাংলাদেশেও এ ধরনের ইঞ্জিনের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। ফলে এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশের বাজারে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। পাশাপাশি বিদেশে দক্ষতার চাহিদা অনুযায়ী পাঠক্রম ঠিক না করায় এসব প্রশিক্ষণ কোনো কাজেই লাগছে না।
চার-পাঁচটি টিটিসি ছাড়া বাকি কেন্দ্রগুলো থেকে তেমন দক্ষ কর্মী তৈরি হয়নি বলে জানায় আইএমইডি। আইএমইডির তথ্য অনুসারে, মাত্র পাঁচটি কেন্দ্র থেকে মোট প্রশিক্ষণের প্রায় ৪৪ শতাংশ দক্ষ কর্মী তৈরি হয়েছে। আর শেষের দিকে থাকা পাঁচ কেন্দ্রের অবদান মাত্র ৭ শতাংশ। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সেন্টারটি অন্যতম। এখান থেকে ছয় বছরে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মাত্র দুই হাজার ২২৯ জন। একই চিত্র পঞ্চগড়েও। এই কেন্দ্র থেকে ছয় বছরে সাড়ে তিন হাজারেরও কম শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
এই প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে যেতে পেরেছেন ৮ থেকে ১২ শতাংশ প্রশিক্ষণার্থী। আর দেশে কাজ পেয়েছেন ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মতো। বাকি ৭০ শতাংশই কাজ না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। এর ফলে ধীরে ধীরে তরুণদের আগ্রহ কমতে শুরু করেছে। তাই নতুন করে প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ না করে বিদ্যমানগুলো আধুনিকায়ন ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে আইএমইডি।
বিএমইটির প্রশিক্ষণকেন্দ্র তৈরি হলেও সঠিক প্রশিক্ষণ হচ্ছে না বলে জানান অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর। তিনি বলেন, ‘বিএমইটির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেটার সঙ্গে প্রশিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ আমার বিল্ডিং আছে, কিন্তু প্রশিক্ষক নেই। এ ছাড়া বিএমইটির প্রশিক্ষকদের গুণগত মানেরও সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তি বা আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করে বিএমইটির প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণ দিতে অভ্যস্ত নন।’
তবে বিএমইটির সব প্রশিক্ষণকেন্দ্র সঠিকভাবে চলছে বলে দাবি করেন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক শহীদুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের ২৭টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের মধ্যে ২০১৪ সালে ১০টি কেন্দ্রে লোকবল নিয়োগ দিয়েছি। আর ২০২১ সালে ১৭টি কেন্দ্রে লোকবল নিয়োগ করেছি। এখন প্রতিটি কেন্দ্রের প্রতিটি ট্রেডে যত শিক্ষার্থী দরকার, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীদের এখন ভর্তি হতে গেলে পরীক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতা করে আসতে হচ্ছে।’
[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি শামস শামীম ও ঝালকাঠি প্রতিনিধি কে এম সবুজ]
এটিভি/এস