বিনোদন ডেস্ক, এটিভি সংবাদ

চিত্রনায়ক মান্নার মৃত্যুর পর থেকে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির অ্যাকশন সিনেমা প্রায় একচেটিয়া করে নিয়েছেন দেশের শীর্ষ তারকা শাকিব খান। বলিউড সিনেমায় যেখানে বুড়ো হয়ে যাওয়া নায়করাসহ ডজনেরও বেশি অ্যাকশন সিনেমার নায়ক, সিনেমাও করেন বছরে একটা-দুইটা সেখানে এক শাকিব খান এ পর্যন্ত প্রায় আড়াইশ’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন যার নিরান্নব্বই শতাংশই অ্যাকশনধর্মী। এ ক্ষেত্রে শাকিব খান নিজেকে এতটাই অপরিহার্য করে তুলেছেন, মাঝেমধ্যে দু’-চারটি নন-অ্যাকশনধর্মী যেসব সিনেমায় অভিনয় করেন কিছুটা রোমান্টিক, কিছুটা অ্যাকশন- এ রকম সিনেমাও সুপারহিট হয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ হিমেল আশরাফের ‘প্রিয়তমা’ সিনেমাতেও দেখা গেছে নন-অ্যাকশনধর্মী হলেও সিনেমাটি দেখতে উপচেপড়া দর্শক। এর আগে যেমন ‘গলুই’তে দেখা গিয়েছিল ‘প্রিয়তমা’ তেও তাই দেখা গেল।

তবে এই দর্শক একান্তই শাকিবের দর্শক- নন-অ্যাকশনধর্মী সিনেমার দর্শক বলা যাবে না। নয়ত সব নন-অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় কমবেশি দর্শক হতো। শুধু শাকিব খানই নয় সম্প্রতি অ্যাকশন সিনেমাই যেন হ্রাস পাওয়া শুরু করেছে। সেখানে ঠাঁই করে নিচ্ছে কিছুটা রোমান্সসহ থ্রিলার ও সামাজিক ভাষার সিনেমা। সিনেমায় বদলে যাওয়া এই ভাষাটিরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে ঢাকাই সিনেমায়। অ্যাকশন সিনেমার দর্শক কমতে থাকায় নতুন নির্মাতারা সিনেমায় নতুন ভাষা নির্মাণের দিকে ঝুঁকছেন এখন। এতে বড় ভূমিকা রাখছেন টেলিভিশনের নাটক ও টেলিফিল্ম নির্মাতারাই মূলত।

‘প্রিয়তমা’ সিনেমার তরুণ পরিচালক হিমেল আশরাফ মূলত নাটক, টেলিফিল্মেরই মানুষ। প্রিয়তমার আগে তিনি বানিয়েছিলেন ‘সুলতানা বিবিয়ানা’। একইভাবে শাকিবের এর আগের রোমান্স ও সামাজিক ঘরানার সিনেমা গলুইয়ের পরিচালক এস এ হক অলীকও ছিলেন টিভি নাটক, টেলিফিল্মেরই মানুষ।

যারা সরাসরি ছোটপর্দা থেকে বড়পর্দায় এসেছেন তাদের সিনেমায় ছোটপর্দার ছোঁয়া থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আবার যারা সরাসরি বড়পর্দার পরিচালক তাদের সিনেমায় ছোটপর্দার ছোঁয়া আনা কঠিনই হবে। তাদের সিনেমায় প্রেম, রোমান্স, পরিবার, সমাজ বড়পর্দায় দেখানো প্রচলিত ধরন অনুযায়ীই ফুটে ওঠবে সেটাই স্বাভাবিক। যেমন, যারা সরাসরি মঞ্চ অভিনয় থেকে ছোটপর্দার অভিনয়ে এসেছেন তাদের অভিনয়ের ভাষায় যেমন মঞ্চের কিছুটা ছোঁয়া থাকে বলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, আবার যারা মঞ্চের বাইরে থেকে ছোটপর্দায় আসেন তাদের অভিনয়ের ভাষাও একটু অন্যরকম হয়ে থাকে। সেজন্যই মঞ্চের অভিনয় শিল্পীদের সিনেমায় অভিনয় করার ভাষাটি কিছুটা বেমানান দেখায়। বিশেষ করে অ্যাকশনধর্মী সিনেমায়। তবে এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি।

মূলত এখন ঢাকাই সিনেমায় ছোটপর্দার পরিচালক বেড়ে যাওয়াতেই সিনেমার প্রচলিত ভাষাও বদলে যেতে শুরু করেছে। আবার এই ছোটপর্দার পরিচালকদের প্রায় সবাই যেসব সিনেমা বানাচ্ছেন তার বেশির ভাগই সরকারি অনুদানের সিনেমা। আর সরকারি অনুদানে যেসব সিনেমাকে অনুপ্রাণিত করা হয় সেসব সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে ছোটপর্দার নির্মাতারাই সবচেয়ে বেশি জুতসই হয়ে থাকেন। তার প্রমাণ ইতোমধ্যেই তারা সবাই হাতেনাতে দিয়েছেন। ছোটপর্দার নির্মাতারা যেহেতু অ্যাকশনধর্মী সিনেমা বানাতে অসফল এবং সরকারি অনুদান অ্যাকশনধর্মী সিনেমা বানানোর ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করে না- সে কারণেও সম্প্রতি ঢাকাই সিনেমায় অ্যাকশনধর্মী সিনেমা কমে আসছে।

সম্প্রতি ঈদে যে পাঁচটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে তার প্রায় সবই প্রেম-রোমান্সধর্মী সিনেমা। কোনো ঈদে একটি পরিপূর্ণ অ্যাকশন সিনেমা থাকবে না- সেটা যেন সত্তর দশকের পর এবারই প্রথম দেখা গেল। শুধু তাই নয়, এবার একাধিক নন-অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় প্রচুর দর্শকও দেখা গেছে। চয়নিকা চৌধুরীর ‘প্রহেলিকা’ নামের যে সিনেমাটি প্রথমে প্রেক্ষাগৃহ পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল (৮টি) সেই সিনেমাটিই দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা না কমে বরং বেড়ে গেছে (১৩টি)। এমন নজির তো ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির জন্যও ইতিবাচক। সামনে যে কয়টি সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে তাতেও নন-অ্যাকশনধর্মী সিনেমাই বেশি। সম্প্রতি বেশ কয়টি নন-অ্যাকশনধর্মী সিনেমা যেরকম দারুণ রেকর্ড গড়া ব্যবসা করেছে তাতে আরও অনেকেই নন-অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে নন-অ্যাকশনধর্মী নতুন ভাষার সিনেমা বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। হয়ত সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও বুঝে গেছে অ্যাকশনধর্মী সিনেমা শাকিব খান বড়জোর আর পাঁচ থেকে সাত বছর টেনে নিয়ে যেতে পারবেন। অথচ ততদিনে শাকিবের হাল ধরবেন- এখন পর্যন্ত এমন কোনো নায়কই ইন্ডাস্ট্রিতে জ্বলে উঠতে দেখা যাচ্ছে না।

কাজেই পরবর্তী সময়ে অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় হাল ধরার মতো নায়ক না থাকলে খোদ ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিই বিপদে পড়ে যাবে। তখন নতুন দর্শকপ্রিয় অ্যাকশনধর্মী সিনেমা না তৈরি হলে কী হবে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ! সেজন্যও হয়ত নতুন ভাষার সিনেমা এবং তার একটা অভ্যস্ত দর্শক তৈরি করাতে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নন-অ্যাকশনধর্মী সিনেমার বাজার সৃষ্টির কাজ।

তবে অনেকে মনে করছেন বাজেট কমে যাওয়াতেই এখন নন-অ্যাকশনধর্মী সিনেমা বানানোর হিড়িক পড়ে গেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী রাকায়েত হোসেন বলেন, অ্যাকশন সিনেমা কমে গেছে বা সামাজিক সিনেমা বাড়ছে এর কনক্লুড করার সময় এখনো হয়নি। সমস্যাটি হচ্ছে আগে যে দর্শক ছিল তারা নেই। তাদের রুচির সিনেমা আর উৎসবকেন্দ্রিক সিনেমার রুচির দর্শক এক নয়। উৎসব কেন্দ্রিক দর্শক শীতের পাখির মতো। মানুষ কিন্তু সারাজীবন একই খানা খায় না। মানুষ রুচির পরিবর্তন চায়। কিন্তু আপনি রুচির পরিবর্তন চাইলেও সেটা দিতে পারছেন না। তবে আপনার কথাটি ঠিক, একসময়ে যে কমার্শিয়াল সিনেমা হতো তার দর্শক এখন আর নেই। কাজেই আগের সেই দর্শক এবং সেই প্রেক্ষাগৃহগুলো যদি থাকত তাহলে আপনি এভাবে বলতে পারতেন না। কাজেই ঐভাবে বলা যাবে না অ্যাকশন সিনেমা চলে গেছে।

সম্প্রতি আদর আজাদ যে সিনেমাটি করলেন সেটা তো ফুল অব অ্যাকশন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সিনেপ্লেক্সের দর্শকই বাংলাদেশের দর্শক নয়।

এটিভি/এস