atv sangbad

Blog Post

মাঠ না থাকায় শিশুদের অ্যাসেম্বলি হয় সিঁড়ির নিচে

যশোর প্রতিবেদক, এটিভি সংবাদ

যশোরে ২২৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই খেলার মাঠ। এসব স্কুলের প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী অ্যাসেম্বলি বা খেলাধুলা করে সিঁড়ির নিচে। আর এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মেধার বিকাশ।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিশুদের মানসিক বিকাশে খেলাধুলা খুব জরুরি। অন্যথায় তারা বিকল্প কোনো আসক্তিতে জড়িয়ে যেতে পারে; যা খুবই ক্ষতির কারণ হবে।

সরেজমিনে যশোর শহরের চুড়িপট্টি এলাকার মোহনগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা যায়, এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে ভবন ছাড়া অতিরিক্ত জায়গা নেই এক ইঞ্চিও, যেখানে শিশুরা অ্যাসেম্বলি বা খেলাধুলা করতে পারে। তাই বাধ্য হয়ে ১৩৬ শিশু শিক্ষার্থীকে কয়েক ধাপে সিঁড়ির নিচে অ্যাসেম্বলি করান শিক্ষকরা। আর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এখানকার শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারেনি খেলাধুলাবিষয়ক জাতীয় কোনো ইভেন্টে।
কেবল এ বিদ্যালয় নয়, জেলার ২২৬টি বিদ্যালয়ের একই অবস্থা! খেলার মাঠ না থাকায় টিফিনের সময় ক্লাসে বা সিঁড়িতে বসে সময় কাটায় শিক্ষার্থীরা। তবে তাদেরও মন চায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে। আর সেটা সম্ভব না হওয়ায় শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
মোহনগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আলেয়া পারভীন বলেন, তার স্কুলের বাইরে একবিন্দু জায়গাও নেই। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা করার সমস্যা। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে খেলার মাধ্যমে; অথচ তা হচ্ছে না। সিঁড়িঘরে অ্যাসেম্বলি করাতে হয় বলে হাত-পা নাড়িয়ে যে কিছু ব্যায়াম করবে সেটাও সম্ভব হয় না। তাছাড়া স্কুলের চারপাশে বাড়ি ও মাছ বাজার। এখানকার পরিবেশ খুব নোংরা। একটি খেলার মাঠ হলে সব সমস্যার সমাধান হতো।
একই অবস্থা যশোর শহরের লালদিঘীর পাড় এলাকার মসজিদ মহল্লা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। এ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক রমা রাণী চক্রবর্তী বলেন, প্রতিদিন বাচ্চারা স্কুলে আসে। তাদের পাঠদান করানো হয়। কিন্তু তারা খেলাধুলা করতে পারে না। এ কারণে তার স্কুলে অভিভাবকরা সন্তান পাঠাতে বা ভর্তি করাতে চান না।

তিনি আরও বলেন, জাতীয় অনেক খেলা থাকে; কিন্তু তার প্রস্তুতি নেয়ারও সুযোগ নেই। বাচ্চাদের নিয়ে রাস্তা পার হয়ে পাশের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হয়। বাচ্চাদের আনা-নেয়ায় ঝুঁকিও থাকে।
যশোর রেলরোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আসমা খাতুন বলেন, ‘আমাদের স্কুলের জমির পরিমাণ ১৪ শতক, যার মধ্যে ৯ শতকে স্কুলের ভবন। বাকি জমিকে মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। ফলে অ্যাসেম্বলি ও খেলাধুলা করাতে সমস্যা হয়। এজন্য ছেলে-মেয়েরা হীনমন্যতায় ভোগে। তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের স্কুলের পাশেই অনেক ফাঁকা জমি রয়েছে। সরকার যদি তা অধিগ্রহণ করে স্কুলকে দিলে ভালো হতো।’

যশোরের বেজপাড়া আজিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাজমা ভূঁইয়া বলেন, শিক্ষা মানে আনুষ্ঠানিক পড়ালেখা নয়। এর সঙ্গে খেলাধুলাসহ আরও অনেক কিছু থাকে। স্কুলে বড় মাঠে অ্যাসেম্বলি করানো, জাতীয় সংগীত গাওয়া ইত্যাদি শিশুদের মনকে প্রভাবিত করে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের রুটিনে খেলারও ক্লাস আছে। কিন্তু স্কুলে খেলার মাঠ না থাকায় সে ক্লাসটি নেয়া হয় না। খেলাধুলা সংক্রান্ত  ইউনিয়ন ও জাতীয় পর্যায়ে অনেক ইভেন্ট থাকে। এজন্য অনুশীলন জরুরি। সেটা করানো সম্ভব হয় না। যে কারণে বাইরে যখন তারা ইভেন্টগুলোতে অংশ নেয়, তখন ভালো করতে পারে না। আর তা শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলে।’
সহকারী শিক্ষক নাজমা ভূঁইয়া আরও বলেন, স্কুলে একটি খেলার মাঠ না থাকলে শিশুদের আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদানটা সম্পূর্ণ হয় না। তাই সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে স্কুলের জন্য মাঠ দেয়া হলে ভালো হতো।
আজিমাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনিকা রহমান বলে, ‘আমার খুব খেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু খেলার মাঠ না থাকায় ক্লাসে বসে থাকি।’
রেলরোড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুস সোবহান বলে, ‘টিফিনের সময় বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে মন চায়। স্কুলে খেলার সরঞ্জাম আছে। কিন্তু মাঠ না থাকায় আমরা খেলতে পারি না।’
তাহিরা তাবাচ্ছুম নামে ৫ম শ্রেণির অপর এক শিক্ষার্থী বলে, ‘আমরা স্কুলে এসে লেখাপড়া করে চলে যাই। অথচ আমার বাড়ির পাশের বন্ধুরা অন্য স্কুলে পড়ে। তারা টিফিনের সময় খেলা করে, অনেক আনন্দ করে। কিন্তু আমাদের কোনো আনন্দ নেই।’
এদিকে, শিক্ষাবিদদের দাবি, শিশুকে গড়ে তুলতে ও তার মানসিক বিকাশে খেলাধুলা খুব জরুরি। অন্যথায় তারা বিকল্প কোনো আসক্তিতে জড়িয়ে যেতে পারে। আর তাহলে সেটা খুবই ক্ষতির কারণ হবে বলে জানান যশোর সরকারি এম এম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন।
তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হয়। খেলতে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, সামাজিকীকরণ হয়। তাই বিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন অবশ্যই মাঠের বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত। বর্তমানে যেসব বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই, সরকারের উচিত সেখানে নতুন মাঠের ব্যবস্থা করা। কারণ, খেলার মাঠ ছাড়া একটি বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ হয় না। আবার শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটে না। আর মেধার বিকাশ না ঘটলে ওই শিক্ষার্থী পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে না।
এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম বলেন, এরই মধ্যে ২২৬টি স্কুলের মাঠ নেই সংক্রান্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মাঠের বিষয়টি সুরাহার একটি প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি, যশোরে বিদ্যালয়ের মাঠগুলো তৈরি করা সম্ভব হবে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, খেলার মাঠ না থাকা ২২৬ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে।
এটিভি/এস

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ব্রেকিং নিউজ :