তাঁদের বেশির ভাগই চিকিৎসক ও কোচিং সেন্টারের মালিক। তাঁরা একটি চক্র গড়ে ২০০১ থেকে পরবর্তী ১৬ বছরে মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অন্তত ১০ বার ফাঁস করেছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন শত কোটি টাকা। তাঁদের মধ্যে আছেন ছাত্রদলের ও ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা।
গতকাল রবিবার দুপুরে রাজধানী ঢাকার মালিবাগে সিআইডির সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ৩০ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে ওই ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার সাত চিকিৎসক হলেন ময়েজ উদ্দিন আহমেদ (৫০), তাঁর স্ত্রী সোহেলী জামান (৪০), মো. আবু রায়হান, জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮), মো. জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮), জিল্লুর হাসান রনি (৩৭), ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২)।
সিআইডির প্রধান বলেন, দেশের মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী বিশাল এক সিন্ডিকেটের খোঁজ পায় সিআইডির সাইবার পুলিশ। ২০২০ সালে মিরপুর মডেল থানায় করা এক মামলা তদন্তে দেখা যায়, চক্রের অন্তত ৮০ জন সক্রিয় সদস্য গত প্রায় ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা ‘আয়’ করেছেন। প্রশ্ন ফাঁস করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে সিআইডি। এর মধ্যে অনেকে পাস করে ডাক্তারও হয়েছেন।
সিআইডি প্রধান জানান, জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে, যেখানে সারা দেশে তাঁর চক্রের অন্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিষয়ে যা জানাল সিআইডি
ময়েজ উদ্দিন আহমেদ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করান। ময়েজ ছাত্রশিবির নেতা ছিলেন এবং পরে ‘জামায়াতের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত।
ময়েজের স্ত্রী গ্রেপ্তারকৃত সোহেলী জামান জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ফেইম কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে স্বামী ময়েজের মাধ্যমে মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান তিনি।
২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান গ্রেপ্তারকৃত মো. আবু রায়হান। তিনি প্রাইভেট কোচিং সেন্টার চালাতেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রাকটিস করেন।
গ্রেপ্তার জেড এম সালেহীন শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে ‘থ্রি-ডক্টরস কোচিং সেন্টারের’ মাধ্যমে মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়ান। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে শোভন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদলের পদধারী নেতা ছিলেন।
গ্রেপ্তার মো. জোবাইদুর রহমান জনি মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়িত। সিআইডি বলছে, তিনি নামকরা বিভিন্ন চিকিৎসকের সন্তানদের প্রশ্ন ফাঁস করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ করে দেন। তিনি মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের হোতা ও বর্তমানে কারাগারে থাকা জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। প্রশ্ন ফাঁসের বাণিজ্য করে দামি গাড়ি-বাড়ি করা, ব্যাংকে অর্থ রাখাসহ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। জনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক।
গ্রেপ্তার জিল্লুর হাসান রনি পঙ্গু হাসপাতালের (নিটোর) চিকিৎসক। ২০০৫ সাল থেকে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০১৫ সালের মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় র্যাবের হাতে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। রংপুর মেডিক্যালে অধ্যয়নকালে ছাত্রদল নেতা ছিলেন। বর্তমানে ড্যাবের সঙ্গে জড়িত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত দলের একজন চিকিৎসক।
গ্রেপ্তার ইমরুল কায়েস হিমেল তাঁর পিতা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে এই প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। বেসরকারি কমিউনিটি ব্যাজড মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে পাস করেন। ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলের আকুরটাকুর পাড়ায় শ্বশুরবাড়িতে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পড়িয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করান।
গ্রেপ্তার জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতা জসীমের বড় ভাই ও স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের খালাতো ভাই। তিনি নিজে আলাদা একটি চক্র চালাতেন। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন।
গ্রেপ্তার রওশন আলী হিমু চক্রের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পুরনো সহযোগী। রওশন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিমু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তার আক্তারুজ্জামান তুষার মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ‘মাস্টারমাইন্ড’ জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। ই-হক নামে কোচিং সেন্টার চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০১৫ সালে র্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হন।
গ্রেপ্তার জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের হোতা জসীমের পুরনো সহচর। ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সাল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিক্যাল কোচিং সেন্টারে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সরবরাহ করতেন।
গ্রেপ্তার আব্দুল কুদ্দুস সরকার টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন। মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁসের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার কলিকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। এরপর ছেলে ইমরুল কায়েস হিমেলকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের সিন্ডিকেট।
এটিভি/এস