যে হারে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে, সে হারে রিজার্ভে বাড়ছে না ডলারের পরিমাণ। এতে আর্থিক হিসাবে ভারসাম্য থাকছে না। রপ্তানি পরিস্থিতি ভালো হলেও প্রবাস আয় ওঠানামা করছে। এমন সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের ডলার খরচ বেশি হচ্ছে।
ইআরডির প্রতিবেদন বলছে, আগামী ছয় বছর পর (২০২৯-৩০ অর্থবছর) বাংলাদেশের সুদাসল পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলার। পাশাপাশি বাংলাদেশ যদি আর কোনো ঋণ না-ও নেয়, তবু ২০৬২ সাল পর্যন্ত ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা কিছুটা চাপে আছি। রিজার্ভে ডলার ওঠানামা করছে। পাশাপাশি স্বল্প মেয়াদে বেশি সুদে নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়ছে। সামনের দিনগুলোতে এই চাপ আরো বাড়বে। তাই এখন থেকে প্রবাস আয় ও রপ্তানি বাড়িয়ে ডলারের তারল্য সংকট কাটানোর চেষ্টা করতে হবে।’
দেশে দুই কারণে বাড়ছে ঋণের চাপ
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, মূলত সহজ শর্তে স্বল্প মেয়াদে ঋণ ও বেসরকারি ঋণের কারণে দেশের অর্থনীতিতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি রয়েছে চীন ও ভারত থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ। সামনের দিনগুলোতে ঋণের সুদ ও শর্ত আরো কঠিন হবে বলে মনে করছেন তাঁরা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের আইডিএ ক্যাটাগরিতে লোনের সুদ ০.৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশে। আর ২ শতাংশের এডিবির ঋণ সুদহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশ সুদহারে। এসব দিক বিবেচনায় সামনের দিনগুলোতে সুদহার আরো বাড়ার এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ আরো কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। পরের ১০ বছরে ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ২০১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। মূলত চীনের ঋণ পরিশোধ শুরুর পর গত দুই-তিন বছর ধরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে। এর সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার ঋণ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছর থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঋণের কিস্তিও পরিশোধ শুরু হবে।
তবে সরকারের এই ঋণ পরিশোধকে চাপ মনে করছেন না পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) তিনি বলেন, ‘আমরা ঋণ করে ঘি খাইনি যে শোধ করতে পারব না। আমরা ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করেছি। পদ্মা সেতু থেকে এখন টোল পাচ্ছি। আর আমরা কখনো ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি। সামনের দিনেও হব না।’
কমেছে বৈদেশিক অর্থছাড় বেড়েছে প্রতিশ্রুতি
সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের অর্থছাড় কমেছে। বেড়েছে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় হয়েছে ৯৯ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের ছাড় হয়েছিল এক লাখ কোটি টাকার বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সরকার ঋণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকার, এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ৮৭ হাজার কোটি টাকার।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সর্বাধিক অর্থ ছাড় করেছে জাপান। দেশটি প্রায় ২১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা অর্থ ছাড় করেছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ২০ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ছাড় করেছে ১৬ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো ঋণ পরিশোধে স্বস্তিজনক অবস্থানে রয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতি একটা ঝড়ঝাপটার মধ্যে রয়েছে। সে জায়গা থেকে রক্ষা পেতে হলে রপ্তানি ও প্রবাস আয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্য রপ্তানি বহুমুখী করতে হবে, বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে হবে, যাতে মাথাপিছু প্রবাস আয় বেশি আসে।’