টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের ফলে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন নগরীসহ পাঁচ উপজেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। বন্যার কারণে আড়াইশ’র বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
এদিকে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় বানভাসি মানুষদের উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ফ্লাইট বন্ধ
বন্যার পানি ইতোমধ্যেই সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। এতে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশ ও বিদেশের বিমান যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শুক্রবার (১৭ জুন) বিকেলে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ এটিভি সংবাদকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, বন্যার পানি ইতোমধ্যেই সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রতিদিনের মতোই আমাদের ফ্লাইটগুলো বিমানবন্দরে অবতরণ ও বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করেছে। কিন্তু রানওয়ের কাছাকাছি বন্যার পানি চলে আসায় এখন থেকে আর কোনো ফ্লাইটের অবতরণ কিংবা উড্ডয়ন সম্ভব হয়নি। অফিসিয়ালি ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
অপরদিকে শুক্রবার জেলার কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বেশিরভাগ এলাকাই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলারও বিস্তীর্ণ এলাকাও পানিবন্দি। পানি বাড়ছে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, জকিগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলায়ও। নগরের অনেক এলাকা এখন পানির নিচে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, শুক্রবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার এবং সিলেট পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সারি নদীর পানি বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার উপরে রয়েছে। পানির উচ্চতা বেড়েছে কুশিয়ারা ও লোভা নদীরও। কুশিয়ারা নদীর ফেফঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপরে বইছে।
সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, জেলার প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের জন্য ৪৪৩টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
এসএসসি পরীক্ষা স্থগিত
সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৯টি উপজেলার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানান সিলেট শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক অরুণ চন্দ্র পাল। সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় বন্যার কারণে সারাদেশে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে। সিলেট শিক্ষাবোর্ডের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে এ বছর ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন পরীক্ষার্থীর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। ১৪৯ পরীক্ষা কেন্দ্রে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
সিলেট জেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গকুল চন্দ্র দেবনাথ বলেন, এ পর্যন্ত জেলায় ২৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। এসব বিদ্যালয়ের পাঠদান সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে।
এছাড়া জেলার ৬০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এগুলোতে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. ওয়াদুদ।
অন্যদিকে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে সিলেটের কুমারগাওয়ের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে। এ উপকেন্দ্র দিয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ইতোমধ্যে সিলেটের পুরো কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও গোয়ইনঘাট উপজেলা এবং সিলেট নগরীর উপশহরসহ কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখতে কাজ করছে সেনাবাহিনী:
বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে সিলেটের কুমারগাওয়ের বিদ্যুতের গ্রিড লাইনের সাব স্টেশনে। এতে পুরো সিলেট ও সুনামগঞ্জ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা দিয়েছে। এ অবস্থায় সিলেটের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে সেনাবাহিনী, সিলেট সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগ।
শুক্রবার দুপুর থেকে কুমারগাও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের চারপাশে বালির বস্তা দিয়ে দিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী। এ ছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের সাকার মেশিন দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঢুকে পড়া পানি শুকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে কুমারগাও সাব স্টেশন তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এটি তলিয়ে গেলে পুরো সিলেট বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়বে। এতে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই আমরা এই কেন্দ্রটি চালু রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। যাতে অন্তত নগরের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে। সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগ এক সঙ্গে মিলে এই কেন্দ্র সচল রাখার চেষ্টা করছি।
এদিকে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিলেট নগরে ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে সিলেট সিটি করপোরেশ।
সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে সিলেট মহানগরীতে ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখনও অনেকেই নিজেদের আসবাবপত্র রেখে আশ্রয় কেন্দ্র আসতে চাচ্ছেন না। তবে বন্যাকবলিত সবাইকে আমরা নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার চেষ্টা করবো।