কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি, এটিভি সংবাদ
নদী ভাঙনের কবলে কিশোরগঞ্জের হাওড় জনপদ। বছরের পর বছর ভাঙতে ভাঙতে মূল মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে হাওড়ের অনেক গ্রাম। বিশেষ করে প্রমত্তা ঘোড়াউত্রা নদীর তীরবর্তী ছাতিরচর, সিংপুর ও আছানপুর গ্রামে দেখা দিয়েছে ভাঙনের তাণ্ডব। গত এক দশকে বিলীন হয়ে গেছে এসব গ্রামের কয়েক হাজার বসতবাড়ি। নদীগর্ভে সর্বস্ব হারিয়ে শত শত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন শহরের বস্তিতে। বছর বছর ভাঙন রোধে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হলেও হচ্ছে না স্থায়ী সমাধান!
সম্প্রতি এ জনপদে ভাঙন রোধে স্থায়ী রক্ষাবাঁধের জন্য সরকার ৬৫৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এরই মধ্যে কাজও শুরু হয়েছে। তবে জনমনে প্রশ্ন: বিশাল এ প্রকল্প কি আদৌ থামাতে পারবে ভাঙনের তাণ্ডব?
ছাতিরচর গ্রামের বাসিন্দা মর্জিনা আক্তার জানান, বাড়ির সামনে ঘোড়াউত্রা নদীর মাঝখানে ছিল তার পূর্ব পুরুষের বসতবাড়ি। নদী ভাঙনে কমপক্ষে পাঁচবার বিলীন হয়েছে তার বসত বাড়ি। অনেকেই ঘরবাড়ি হারিয়ে চলে গেছেন শহরের বস্তিতে। তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েকবার বাড়ি পরিবর্তন করেছি। এবারও নদীর ভাঙন ঘরের কাছাকাছি চলে এসেছে। ভাঙন রোধ করা না গেলে এবারও বসতবাড়ি গিলে খাবে নদী।’
একই গ্রামের মো. আলম বলেন, ‘ভাঙন যেন আমাদের নিয়তি! প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ঘরবাড়ি রক্ষা করার সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয় আমাদের।’ জানা গেছে, নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামটির চারিদিকে পানি। এ একটি দ্বীপ গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন। বর্তমানে এখানে লোকসংখ্যা ২০ হাজারের মতো। এক সময় বিশাল গ্রাম থাকলেও ভাঙতে ভাঙতে এখন অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে।
একইভাবে ভাঙনে বিলীন হচ্ছে পার্শ্ববর্তী সিংপুর ইউনিয়ন ও বাজিতপুর উপজেলার দিঘীরপাড় ইউনিয়নের আছানপুর গ্রাম। এলাকাবাসী জানান, প্রতিবছর ভাঙন শুরু হলেই পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বালির বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করে। কিন্তু যুগের পর যুগ স্থায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে দিন দিন নিঃস্ব হচ্ছেন তারা। তবে আশার কথা হচ্ছে, দীর্ঘদিন পরে হলেও ভাঙন থেকে হাওড়বাসীকে রক্ষায় এবার প্রথম বারের মতো নদী তীর প্রতিরক্ষার কাজ হচ্ছে।
পাউবো বলছে, এবার ভাঙন কবলিত এলাকায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান জানান, কিশোরগঞ্জের ১০টি উপজেলায় ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ, ওয়েব প্রোটেকশন এবং খাল পুনঃখনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। একনেকে অনুমোদনের পর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজও শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় বাজিতপুরের আছানপুর, নিকলী উপজেলার ছাতিরচর ও সিংপুর ইউনিয়নে ১৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে চার কিলোমিটার নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ শুরু হয়েছে।
তিনি জানান, গত ১৫ জুলাই ছাতিরচরে ৫২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এক হাজার ৪শ মিটার স্থায়ী নদী তীর প্রতিরক্ষা, সিংপুরে ৭৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২২০০ মিটার স্থায়ী নদী তীর প্রতিরক্ষা এবং বাজিতপুরের আছানপুরে ৩১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯০০ মিটার স্থায়ী নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ শুরু হয়েছে। গত ১৫ জুলাই নিকলী-বাজিতপুরে নির্বাচনী এলাকার এমপি মো. আফজাল হোসেন প্রকল্পগুলো উদ্বোধন করেন।
পাউবো সূত্র জানায়, নতুন প্রযুক্তির জিওটিউব ও সিসি ব্লক নির্মাণ করায় এসব এলাকা ভাঙনের হাত থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পাবে। ফলে হাওড়ের লক্ষাধিক মানুষ ভাঙনের হাত থেকে বাঁচবে।
অন্যদিকে ভাঙনকবলিত তিনটি গ্রাম রক্ষায় ১১টি স্থানে নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ শুরু হয়েছে উল্লেখ করে স্থানীয় এমপি মো. আফজাল হোসেন জানান, বাঁধ নির্মাণের পর ভাঙনকবলিত ওই তিনটি গ্রামকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তিনি আরও জানান, অবহেলিত হাওড়বাসীকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে দীর্ঘদিন ধরে তিনি চেষ্টা করছেন। অবশেষে হাওড়বাসী ভাঙন থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাচ্ছে।
আফজাল হোসেন আরও বলেন, ‘বাজিতপুর ও নিকলী হাওড়ের ভাঙনকবলিত জনপদকে ভাঙন থেকে রক্ষা করতে এরই মধ্যে ১৬২ কোটি টাকার কাজ শুরু হয়েছে। আগামী দুবছরে কাজ শেষ হবে। আর এটি শেষ হলে সিংপুর, আছানপুর ও ছাতিরচরকে একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’
হাওড় অঞ্চলে প্রতি বর্ষা মৌসুমেই অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে নদীর পানি বেড়ে ভাঙন দেখা দেয়। গৃহহীন হয় শত শত মানুষ। সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চল ছাড়াও সবচেয়ে বেশি ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে কুড়িগ্রাম, বরিশাল, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ। গবেষকরা ভাঙনের জন্য বন্যার পানির স্রোত ও নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনকে দায়ী করছেন।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় নদী তীরবর্তী যেসব এলাকার মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি থাকে, সাধারণত সেসব এলাকায় ভাঙন বেশি হয়। এ ধরনের মাটি বেশি থাকায় পদ্মা ও যমুনার তীরে ভাঙনও বেশি হচ্ছে।
এটিভি/এস