এক সময় ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। একটি বাস দিনে ফরিদপুর থেকে ঢাকা গিয়ে ফিরে আসতে পারতো না। এখন ওই বাসগুলোই পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন তিনবার ঢাকা থেকে ঘুরে আসছে। সময় এবং খরচ কম লাগায় পরিবহন মালিকরা হচ্ছেন লাভবান। নতুন নতুন পরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে। মালিকদের পাশাপাশি শ্রমিকরাও হচ্ছেন লাভবান।
পদ্মা সেতু চালুর পর পরিবহনখাতে ব্যাপক সফলতা এসেছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিনিয়ত এ খাতে কর্মী ও শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। পদ্মা সেতু ব্যবসায়ীদের কষ্ট ও দুর্দশা ঘুচিয়ে দিয়েছে। এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে ফিরে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য।
গোল্ডেন লাইন পরিবহনের হেলপার শামিম হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর ট্রিপের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আগে পদ্মা নদী ফেরিতে পার হতে ভোগান্তি পোহাতে হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। দিনে ঢাকায় গিয়ে ফিরে আসতে পারতাম না। প্রতি আপ ডাউন ট্রিপে ৪শ’ টাকা পেতাম। এখন পদ্মা সেতু হয়ে দুই থেকে তিন বার (৬ ট্রিপ) ঢাকা থেকে ঘুরে আসতে পারি। প্রতিদিন এখন ৮শ’ থেকে ১২শ’ টাকা বেতন পাই।’
ফরিদপুর থেকে ঢাকাগামী পরিবহনের চালক আশরাফ হোসেন বলেন, ‘আগে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে এক ট্রিপ মারতে পারতাম। এখন প্রতিদিন দুই থেকে তিন ট্রিপ মারতে পারি। আগে ট্রিপ প্রতি পেতাম ৬৫০ টাকা। এখন ১ হাজার ৩শ’ থেকে ১ হাজার ৯৫০ টাকা বেতন পাই। এখন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে আবার ফিরে আসতে পারি। আগে কত রাত কাটাতে হয়েছে ফেরিঘাটের যানজটে।’
গোল্ডেন লাইন পরিবহনের চালক কাশেম ফকসে বলেন, ‘পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ঢাকা-ভাঙ্গা সড়কে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে এ রুটে যাতায়াতের সময়ও কমেছে প্রায় এক ঘণ্টা। ফরিদপুর থেকে মাত্র দুই ঘণ্টায় ঢাকার সায়দাবাদ পৌঁছে যাই এখন। আগেতো দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে গাবতলী যেতে দিন পার হয়ে যেতো। আর এখন তিন বার যাতায়াত করতে পারি।’
যাত্রীবাহী পরিবহনের সুপারভাইজার আকাশ মাহমুদ বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর আগে যখন ফেরিঘাট হয়ে চলাচল করতাম, তখন বাড়িতে থাকতে পারতাম না। ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খোঁজ রাখতে পারতাম না। এখন বাড়ি থেকেই ডিউটি করি। স্ত্রী, সন্তানদের দেখভাল করতে পারি। পদ্মা সেতু আমাদের জন্য আশীর্বাদ।’ গোল্ডেন লাইন পরিবহনের ফরিদপুর কাউন্টারের ম্যানেজার রেজাউল করিম বাচ্চু বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আমাদের পরিবহনের ট্রিপের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন ফরিদপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ৬০ থেকে ৬৫ ট্রিপ ছেড়ে যায়। এছাড়া ফরিদপুরের ওপর দিয়ে আমাদের পরিবহনের শতাধিক গাড়ি দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে ফেরিঘাটে আটকে থাকতে হতো বাসগুলোকে। ট্রিপের সংখ্যা কম হতো। এখন গাড়িও বেড়েছে, ট্রিপের সংখ্যাও বেড়েছে। ট্রিপ বাড়ায় আয় রোজগারও বেড়েছে মালিকের।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ফরিদপুর মোটর ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি জুবায়ের জাকি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য উন্নয়নের দ্বার খুলে দিয়েছেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন হয়েছে। শ্রমিকদের কষ্টের দিন শেষ হয়েছে। যে শ্রমিক আগে ৫শ’ টাকা রোজগার করতো, সে এখন এক হাজার টাকা রোজগার করে প্রতিদিন। তবে শ্রমিকদের রোজগার বাড়লেও পরিবহন মালিকরা কিন্তু বেতন বাড়ায়নি। ট্রিপ বাড়ায় বেতন বেশি পাচ্ছে, কিন্তু বেতন আগে যা ছিল, এখনও তাই আছে।’
পরিবহন বাস মালিক মিঠু চৌধুরী বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর আগে অনেক পরিবহন মালিক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। লোকসানের মুখে পড়ে দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর নতুন করে সেই সব ব্যবসায়ী পুনরায় তাদের ব্যবসা শুরু করেছে। আবার নতুন নতুন পরিবহনও চালু হয়েছে। পরিবহন মালিকরা এখন লাভের মুখ দেখছে। যাত্রীসেবার মানও বেড়েছে।’
ফরিদপুর জেলা বাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মো. আনিচুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ অঞ্চলের কয়েক হাজার গাড়ি নতুন করে চলাচল শুরু করেছে। বর্তমানে মালিকরা পরিবহন ব্যবসায় লাভবান হচ্ছেন। আগে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে বাস আটকে থেকে এক ট্রিপও মারতে পারতো না। এখন সেই বাসগুলোই পদ্মা সেতু হয়ে দুই থেকে তিন ট্রিপ মারছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা যাতায়াত করলে আগের থেকে তেল খরচ কম হয়। ফেরি ভাড়া আর সেতুর টোল প্রায় একই। তেল খরচ কম হওয়ায় মালিকরা লাভবান হচ্ছে। আবার সড়ক ভালো হওয়ায় যাতায়াতে গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কম হচ্ছে।’
ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটতে শুরু করেছে। বিশেষ করে পরিবহন ব্যবসায়ী ও পরিবহনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা লাভবান হচ্ছেন। এঅঞ্চলের মানুষের অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এই অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল, প্রধানমন্ত্রী আমাদের এই ব্যথা, কষ্টকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে নানা ষঢ়যন্ত্র মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন। উন্নয়নের যে মহাযজ্ঞ তিনি দেখিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে উনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
এটিভি/এস