atv sangbad

Blog Post

পটুয়াখালী পৌরসভার ‘নদীখেকো’ মেয়রকে অব্যাহতির সুপারিশ

অনুসন্ধানী প্রতিবেদক, এটিভি সংবাদ 

পটুয়াখালী পৌরসভার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ফৌজদারি খাল। এক পসলা বৃষ্টিতে, হাঁটু পানিতে ভেসে যেত শহর। সেই জলাবদ্ধতা নিরসনে এই খালের গুরুত্ব সীমাহীন। ফৌজদারি খাল তাই পৌরসভার প্রাণ।

সেই খালের প্রাণ রক্ষার দায়িত্ব যার, তিনিই গলা টিপে খাল হত্যা করছেন বলে অভিযোগ। তারই অংশ হিসেবে খাল দখল করে নিজস্ব বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। সেই খালের উৎসমুখ লাউকাঠী নদী। নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে তিনি খেয়াঘাট স্থাপন করেছেন।

পাশপাশি পৌরসভার ময়লা ফেলে সেই নদী ভরাট চলছে। একইসঙ্গে পৌরসভার সুয়ারেজ লাইন নদী ও খালের সাথে সংযোগ দিয়ে পানি দুষিত করা হচ্ছে।

‘নদীখেকো’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র।

মেয়রের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ ও নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করায় তাকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে পৌরসভার প্রশাসক নিয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী চলতি বছরের ১৪ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের বরাবরে এই সুপারিশ করেন। সেই অনুরোধপত্রের অনু‌লি‌পি বৃহস্পতিবার পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে।

পটুয়াখালী পৌর শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুতিখালী খাল।

সেই খালের জায়গা ভরাট করে জনগণের করের টাকায় পৌরসভা রাস্তা নির্মাণ করেছে। এই খাল যখন ভরাট প্রক্রিয়া চলছিল, তখন নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে আসেন। স্থানীয় বৃদ্ধ মাকসুদুর রহমান তালুকদার খাল ভরাটের প্রতিবাদে পৌরসভার মেয়রের উপস্থিতিতে ওইদিন নদী কমশনের কাছে বক্তব্য দেন। নদী কমিশনের কাছে বক্তব্যের পর তার লাশ মেলে শ্মশানে।

সংবাদ প্রকাশের পর ১৫ সেপ্টেম্বর নিহতের পরিবার বাদী হয়ে পটুয়াখালী জেষ্ঠ হাকিম আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পৌর মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদকে ওই মামলার প্রধান আসামি করা হয়। আদালতে নির্দেশে বৃদ্ধর লাশ উত্তোলন করা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য ভিসেরা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আদলতের নির্দেশে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করছে।

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবরে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেখানে পৌরসভার মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদকে অপসারণের সুপারিশ করেছেন। পাশাপাশি প্রশাসক নিয়োগেরও পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করেছেন। সেই চিঠির একটি অনুলিপি জেলা প্রশাসনকে পাঠিয়েছে নদী রক্ষা কমিশন। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগ আমাদের কোনো নির্দেশনা দেননি। সচিব মহোদয় নির্দেশনা দিলে তা দ্রুত বাস্তবয়নে জেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর তিন দিনের সফরে পটুয়াখালী আসেন। প্রথম দিন তিনি পৌর শহরের লাউকাঠি, লোহালিয়া ও বহালগাছিয়া নদী পরিদর্শন করেন। সরেজমিনে পরিদর্শনকালে তারা দেখতে পান, পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ ফৌজদারি খালের জায়গা দখল করে নিজস্ব বাসভবন নির্মাণ করেছেন। এতে করে মেয়র ওই খালের পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ করছেন।

এ ছাড়াও পৌরসভার মেয়র নির্দেশে পৌর কর্তৃপক্ষ লাউকাঠি নদীর দক্ষিণ পাশে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে খেয়াঘাট স্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে নদীর তীরে প্রতিদিন পৌরসভার ময়লা ফেলা হচ্ছে। এভাবে ময়লা-আবর্জনা ফেলে লাউকাঠি নদীর জয়গা ভরাট করা হচ্ছে। বিসিক শিল্পনগরীর পাশে পটুয়াখালী সেতু হতে তুলাতলা খাল পর্যন্ত লাউকঠি নদীর জমিতে পৌরসভা ময়লা ফেলে নদীর জায়গা ভরাট ও দূষণ করছে। এ ছাড়াও পৌরসভার সুয়ারেজ লাইন নদী ও খালের সাথে সংযোগ দিয়ে নদী ও খালের পানিকে দুষিত করছেন। সুতিখালী খালের জায়গা ভরাট করে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ রাস্তা নির্মাণ করেছে।

নদী কমিশন সরেজমিন পরিদর্শন শেষে ৭ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের সন্মেলন কক্ষে পৌরসভার মেয়রের অংশগ্রহণে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কমিশনের চেয়ারম্যান নদী খাল রক্ষায় পৌরসভা মেয়রকে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেন। স্থানীয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে মেয়র আশ্বাস দেন যে, ফৌজদারি খালের জায়গা অবৈধভাবে তার নির্মিত নিজস্ব ভবনের অপসারণসহ কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক সকল সমস্যা সমাধান করবেন। তার সেই ভিডিও বক্তব্য নদী কমিশনের কাছে সংরক্ষিত আছে। পরবর্তিতে নদী কমিশনের পক্ষ থেকে পৌরসভার চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে বিষয়টি অবহিত করা হয়।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাতকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সদস্যরা গতবছরের ৪ ডিসেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পটুয়াখালীতে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তারা সরেজমিনে এসে দেখতে পান, পৌরসভা কর্তৃক কমিশনের কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। উল্টো সুতিখালী খালের উপর নির্মিত রাস্তাটি সম্পূর্ণরূপে নির্মাণ করে খালটিকে সম্পূর্ন অস্তিত্বহীন করে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নদী ও খালের দূষণের পরিমাণ পূর্বেও তুলনায় আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত যখন পটুয়াখালীতে সরেজমিনে আসেন, তখন পৌর মেয়র দেশের বাইরে ছিলেন। সেই কারণে প্যানেল মেয়রকে কমিশনের সকল সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত মৌখিকভাবে নির্দেশনা প্রদান করেন। পরবর্তিতে চলতি বছরের ৯ এপ্রিল সকল সমস্যা সমাধান করে ১৫ দিনের মধ্যে কমিশনে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য পৌর মেয়রকে লিখিতভাবে অনুরোধ করা হয়। এই ঘটনার পর পৌরসভা সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো প্রতিবেদন কমিশনে পাঠায়নি।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশের মাধ্যমে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেশের সকল নদীর আইনগত অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করেছে। পৌর মেয়র কর্তৃক জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশকে অবজ্ঞা হাইকোর্টেও রায়ের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ছাড়াও স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ এর ধারা ৫০এ অধীন উপধারা ২ এর ১ (গ) নং কার্যাবলি সঠিকভাবে সম্পাদন করেনি। পাশাপাশি প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করেছেন। এজন্য মেয়র সরাসরি দায়ী বলে আমাদের পর্যাবেক্ষণে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে। তাই মেয়রকে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি প্রদান করে প্রশাসক নিয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সচিবকে অনুরোধ জানিয়েছি।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ব্রেকিং নিউজ :