atv sangbad

Blog Post

atv sangbad > খেলাধুলা > আর কত কলঙ্কিত করবে বাফুফে বাংলাদেশের ফুটবলকে?

আর কত কলঙ্কিত করবে বাফুফে বাংলাদেশের ফুটবলকে?

নিউজ ডেস্ক, এটিভি সংবাদ : 

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)-এর কর্মকর্তারা নতুন করে যে ফিফার শাস্তি পেতে যাচ্ছেন তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল আগে থেকেই। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার জানা গেল, দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়মের প্রমাণ মেলায় বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাম মুর্শেদীকে ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা করেছে ফিফার নৈতিকতা কমিটি।

ফিফার ওয়েবসাইটে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয় এই তথ্য।

জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার সালাম মুর্শেদী বাফুফের ফিন্যান্স কমিটির প্রধান। তিনি বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতির পদে আছেন প্রায় ১৭ বছর। বাফুফের ক্রয় ও পরিশোধের প্রক্রিয়াগুলোতে মিথ্যা তথ্য, ত্রুটিপূর্ণ ক্রয়াদেশ এবং ভুয়া কাগজপত্র পরিবেশনের দায়ে তাকে এই শাস্তি দিয়েছে ফিফা। এর মাধ্যমে আরেকবার কলঙ্কিত হলো দেশের ফুটবল।

যে ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, সেই ফুটবলে তো উন্নতির ছোঁয়া লাগার কথা ছিল। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদদের তালিকায় তার নাম থাকবে ওপরের দিকে। কিন্তু ২০০৮ সালে কাজী সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের ফুটবলে উন্নতির কোনো লক্ষণ কি দেখা গেছে আদৌ?

শুধু বিতর্ক আর নেতিবাচক শিরোনামেই বেশি থেকেছেন কাজী সালাউদ্দীন। মাঠের খেলায় উন্নতি নেই, বরং মাঠের বাইরের বিষয়ের নানা সমালোচনা ঘিরে থেকেছে তাকে। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে তো নামতে নামতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৪ তে এসে ঠেকেছে।

ফুটবল মাঠে দাপটে খেলা সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতি হিসেবে কতটা সফল? এ প্রশ্নের উত্তর রাজ্যের হতাশা নিয়ে আসে মনে। অথচ যে দেশের প্রতিটি জায়গায় রাজনীতির বাতাবরণ, সেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তিনিই বলা চলে একমাত্র ফেডারেশন সভাপতি, যিনি খেলাটা মাঠে খেলে এসেছেন খুব দাপটের সঙ্গে। সাবেক ফুটবলার হওয়ায় বাড়তি গ্রহণযোগ্যতাও শুরুর দিকে ছিল তার।

কিন্তু যতই দিন গড়িয়েছে তার অভিভাকত্বে দেশের ফুটবল শুধু বিতর্ক আর কলঙ্কের ঘেরাটোপেই আটকে থেকেছে।

বাফুফের বর্তমান কমিটি যে দুর্নীতি আর অস্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তা নিয়ে সাবেক ফুটবলাররা সব সময় সরব ছিলেন। আর তাদের কথাগুলোর প্রমাণ মেলে যখন গত বছর ১৪ এপ্রিল জালিয়াতি, অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগকে।

ফুটবল অঙ্গনে গুঞ্জন সোহাগের পরামর্শ ছাড়া বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন কখনো কোনো কাজ করতেন না। মোটা দাগে অনেক বিষয়ে সোহাগের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন কাজী সালাউদ্দিন।

বৃহস্পতিবার ফিফা সোহাগের ওপর নতুন করে আবারও শাস্তি আরোপ করেছে। বৃহস্পতিবার থেকে আরও ৩ বছর ফুটবলের যে কোনো কার্যক্রম থেকে দূরে থাকতে হবে তাকে। ২০২০ সাল পর্যন্ত ‘অপরাধের’ জন্য সোহাগকে প্রথম যে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল সেটার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত এপ্রিলে। এবার ধরা পড়েছে ২০২২ সালের আর্থিক জালিয়াতি। এ কারণে নতুন করে শাস্তি পেলেন তিনি। নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ২০ হাজার সুইস ফ্রাঁ আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে তাকে।

এই দুজন ছাড়াও বাফুফে থেকে চাকরিচ্যুত প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আবু হোসেন ও অপারেশন্স ম্যানেজার মিজানুর রহমানকে ২ বছর নিষিদ্ধ ও ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা করেছে ফিফা। এছাড়া বাফুফের প্রোকিউরমেন্ট ও স্টোর অফিসার হাসান শরীফকে সতর্ক করার পাশাপাশি ফিফার কমপ্লায়েন্স ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে বলা হয়েছে।

সালাম মুর্শেদীর কর্মকাণ্ডের ৫২ পৃষ্ঠার একটা তদন্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা আছে ফিফার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। এই রায় ফিফার নৈতিকতা কমিটি অনুমোদন করে গত ৭ মার্চ।

সোহাগের ওপর ফিফার নিষেধাজ্ঞা নেমে আসার পর ব্যাপক আলোড়ন হয়েছিল ফুটবল অঙ্গনে। গত বছর (২০২৩)-এর ১৭ এপ্রিল বাফুফে জরুরি সভায় সোহাগকে আজীবন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেন সালাম মুর্শেদী। বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনকে সেদিন কোনো কথা বলতে না দিয়ে নিজেই সংবাদমাধ্যমের সব প্রশ্নের জবাব দেন। সেদিন দৃশ্যত সব প্রশ্নের উত্তর নিজের মতো করেই দিয়েছিলেন তিনি। তবে প্রশ্নগুলোর সঙ্গে উত্তরের সাদৃশ্য মেলেনি অনেক ক্ষেত্রে। সেদিন বারবার নিজেকে ও নিজের আওতাধীন ফিন্যান্স কমিটিকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।

এবারও সালাম মুর্শেদী সেই একই কথা বলছেন। তার দাবি, ইচ্ছাকৃতভাবে তিনি কোনো ভুল করেননি, ” বাফুফের কর্মচারিরা আমাদের যা করে দেয়, সেটার ওপরই আমরা কাজ করি। যদি কোনো দায়িত্বে অবহেলা মনে করে থাকে, আমার জরিমানা দিয়ে দিতে হবে। এখানে বিষয়টা এমন না যে, আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটা করেছি।”

বাফুফের কাজের প্রক্রিয়া নিয়ে সালাম মুর্শেদী বলেন, “এটা তো চেইন ওয়ার্ক। এভাবে যখন কোনো কাজ আসে, সেখানে যে-ই সই করবে, মনে হবে এটা তারই ভুল। আমি যখন কোনো কিছুতে সই করি তখন সব প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করি। ফিফা, এফসির চূড়ান্ত অনুমোদন দেখেই সই করি যে ওই খাতে টাকাটা সঠিক আছে কিনা। এখানে ভুল থাকতে পারে কিনা আমি জানি না।”

টাকার অঙ্ক ঠিক আছে কিনা তা দেখে তিনি সই করেন। তবে তার দাবি, আগে দরপত্র বানিয়ে সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ ও তার সঙ্গীরা যে অপকর্ম করতেন তা তার জানা ছিল না।

বাফুফের বর্তমান কমিটির এসব কার্যক্রম নিয়ে শুরু থেকেই ক্ষুব্ধ জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু। ফিফার রায় পাওয়ার পর তিনি বলেন, “এই ঘটনার পরে যা দাঁড়িয়েছে আমাদের ভাবমূর্তি যেভাবে সারা বিশ্বে নষ্ট হলো, তাতে আমি বলবো এই কমিটি অতি সত্বর পদত্যাগ করে আমাদের যতটুকু সম্মান আছে ততটুকু যেন রক্ষা করে।”

তিনি মনে করেন এখন বাফুফের বর্তমান কমিটির সরে দাঁড়ানো উচিত, “বারবার বলে এসেছি তারা পারছে না। তারা ব্যর্থ। তারা সরে দাঁড়াক। কিন্তু আমাদের কথা শোনেনি কেউ। এখন ফিফার মতো একটা প্রতিষ্ঠান যেখানে তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা করেছে এতেই প্রমাণ হয় যে আমাদের সঙ্গে তাদের কথার মিল আছে। আমরা যেটা বলেছি সেটা তারা তদন্ত করে দেখেছে, সেটাই হয়েছে।”

বাফুফের এই অনিয়ম নিয়ে সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক আনিসুর রহমান বলেন, “কাগজ-কলমে তদন্ত করে ফিফা যেভাবে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে এতে এটা পরিস্কার যে কোথায় কোথায় তাদের অনিয়ম ছিল। এগুলো নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে। এমনকি কার্যকরী কমিটির সদস্যরাও প্রশ্ন তুলেছেন। বিএফএফ যে সকল অডিট ফার্ম দিয়ে তাদের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অডিট করিয়েছিল, বেশ কয়েক বছরের অডিট রিপোর্ট আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল।  ফার্মের সে সকল প্রতিবেদনের শুরুতেই পরিস্কার পর্যবেক্ষণ লেখা ছিল, যে সব প্রক্রিয়ায় অডিট করায় এবং অ্যাকাউন্ট মেইনটেন করে , বিল ভাউচার আরো স্বচ্ছ হতে হবে। পেমেন্টের ক্ষেত্রে ক্যাশ কমিয়ে অ্যাকাউন্ট টু অ্যাকাউন্ট হতে হবে। প্রতিটা এক্সটার্নাল অডিট ফার্ম পর্যবেক্ষণ দিয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করেছে বাফুফেকে। কিন্তু বাফুফে যা করেছে সেটা হলো- এক বছর যে প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিট করিয়েছে, পরের বছর সেটা করিয়েছে অন্য অডিট ফার্ম দিয়ে। এবং পরের প্রতিষ্ঠানগুলোও একই ধরনের পর্যবেক্ষণ দেয় হিসাবের স্বচ্ছতার জন্য। কিন্তু আমরা কখনোই দেখিনি যে বাফুফের সেগুলো বাস্তবায়ন করেছে।”

বাফুফের কর্মকর্তাদের এই শাস্তিতে তাই খুব বেশি অবাক নন সাংবাদিক আনিসুর রহমান, “ফিফা যখন গোপনে তদন্ত শুরু করে এসবের, শেষ দিকে আমরা জানতে পারি তা। আমি ব্যক্তিগতভাবে মোটেও অবাক হইনি এসব নিয়ে, কারণ, এক্সটার্নাল অডিটের যে পর্যবেক্ষণ ছিল সেই সব জায়গায় ফিফা সমস্যাগুলো ধরেছে। যেমন বড় কোনো কাজের ক্ষেত্রে কোটেশন বা দরপত্র চাওয়া লাগে, বিল ভাউচার নিজেরা তৈরি করে জমা দিয়েছে। বাইরে এটা নিয়ে সব সময় আলোচনা ছিল। এমনও শোনা গেছে সোহাগ ও বিএফএফ-এর কিছু এমপ্লয়ির নিজের প্রতিষ্ঠান মালামাল সরবরাহ করে। এসব করলে তো সমস্যা তৈরি হবে। শেষ পর্যন্ত ফিফা এটা প্রমাণ করেছে।”

পুরো বিষয়ে সালাম মুর্শেদীর দায় দেখেন তিনি, ” যেহেতু সালাম মুর্শেদী ফিনান্স কমিটির প্রধান, এটার দায় তিনিও এড়াতে পারেন না। তিনিও বড় একটা কোম্পানি চালান, তার প্রতিষ্ঠানের মতো করেও যদি বাফুফেতে অ্যাপ্লাই করতো তাহলে এই পর্যায়ে বিষয়টা আসতো না। ফাইনাল গেটকিপার তিনি, একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীও বাংলাদেশের। তিনি যদি সব আস্থা সোহাগদের ওপর না রাখতেন, তাহলে এতদূর বিষয়টা আসতো না।”

মাঠের বাইরের সব নেতিবাচকতা ঝেড়ে ফেলে সামনের দিকে তাকানোর সময় এসেছে কাজী সালাউদ্দিনের। আর তা না হলে অমর্যাদা ও অস্তিত্বের সংকটে পড়া ফুটবল হয়ত অচিরেই হারিয়ে যাবে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ব্রেকিং নিউজ :