atv sangbad

Blog Post

atv sangbad > সম্পাদকীয় > দেশে কেনো সীমাহীন দুর্নীতি?

দেশে কেনো সীমাহীন দুর্নীতি?

এস এম জামান, এটিভি সংবাদ 

লেখনী শুরু সাফল্যের কথা দিয়েই। জাতিসংঘ কর্তৃক এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য তিনটি বিষয় অর্থাৎ মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে জাতিসংঘ।

২০১৮-২০২১ সালের মূল্যায়নে তিন সূচকেই মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে বের হতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে! বাংলাদেশের জন্য এটি অনেক বড় অর্জন। একদা যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলে অনেকটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল সেই দেশ এখন উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পেরেছে। এটা যে কত বড় আনন্দ ও গৌরবের তা দেশের সব মানুষই অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারছেন।

আজ যে ছেলে অথবা মেয়েটির বয়স ২৫ অথবা ৩০ বছর সে হয়তো ভালো করে জানেও না মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বাধীন দেশটিকে এগিয়ে নিতে কী কষ্টটাই না করতে হয়েছে।

আজ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের যে মুখচ্ছবি আমরা দেখি, ২৫/৩০ বছর আগে এমনটা ছিলো না। অসহায় ও নিরাপত্তাহীন মুখচ্ছবি দেখে দেখে একটা কথা মনে হতো, এই মুখে হাসি কি ফুটবে কোনো দিন? ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি স্বাধীন বাংলাদেশ? এখন অহংকারের সঙ্গেই বলা যায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ!

জাতিসংঘ কর্তৃক এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশই এর যথার্থ প্রমাণ! বাংলাদেশকে যারা তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ ভেবেছিল তারাও এখন সুর পাল্টে ফেলেছে। বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। যে দেশের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেই দেশ অর্থাৎ পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদেরও অনেকেই এখন উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার উদাহরণ টানতে গিয়ে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করছে।

ভারতের প্রচারমাধ্যমে মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করা হচ্ছে। এই যে সাফল্য, তার কৃতিত্ব বর্তমান সরকারের। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় সগৌরবে এগিয়ে যাচ্ছে বলেই জাতিসংঘ বাংলাদেশকে এই স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এ অর্জনের কৃতিত্ব দিয়েছেন দেশের আপামর জনসাধারণকে। তিনি বলেছেন, সাড়ে ১৪ বছর ধরে সরকার পরিচালনায় নিরন্তর পরিশ্রম ও পরিকল্পনার ফসল হচ্ছে এই অর্জন। এই কৃতিত্ব এদেশের আপামর জনসাধারণের।

বালিশ-কাণ্ড, পর্দা কেলেঙ্কারি, রুবেল-বরকতের ভূমি দস্যুতা, স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম, ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া সহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে শুরু করলো সবাই…

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে, রক্ষা করা কঠিন। উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই, এজন্য বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়।

ঋণ করলে আত্মার স্বাধীনতা নষ্ট হয়। কাজেই আমরা আর ঋণ করতে চাই না। কারও সাহায্যও চাই না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। কিন্তু সেই সক্ষমতার জায়গাটা কি পরিষ্কার? এক্ষেত্রে গর্বের পদ্মা সেতু আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

তবুও জনমনে যেন খটকা লেগেই আছে। আসুন দেখি, সাধারণ মানুষের ভাবনাটা কেমন? একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, শুধু ঢাকা শহর নয় দেশের প্রতিটি শহর ও গ্রাম পর্যায়ে চায়ের দোকানের আড্ডায় রাজনৈতিক আলোচনা বেশ গুরুত্ব পায়। কোনো কোনো আড্ডা অনেকটা টেলিভিশনের টকশো’র মতো। দু’জন হয়তো তর্ক করে যাচ্ছেন। অন্যরা তা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। মাঝে মাঝে বলছেন, ‘হয় হয়… কথা ঠিক’।

ঢাকা শহরের একটি ব্যস্ত রাস্তার মোড় ঘেঁষে এমনই এক আড্ডার চিত্র তুলে ধরছি আপনাদের সামনে। ছোট্ট চায়ের দোকান। মুখোমুখি বেঞ্চ পাতা। বেঞ্চের ওপর বসে আছেন জনা দশেক নানা পেশার মানুষ। একজন কথা বলছেন।

অন্যরা কেউ চা খাচ্ছেন। কেউ বক্তার কথা শোনার জন্য বেঞ্চের ওপর বসে আছেন। তাদেরই একজন বক্তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘ভাই সবই বুঝলাম। আমাদের দেশ উন্নত হয়ে যাবে। আমরা আর গরিব থাকবো না। এটা আনন্দের খবর। গরিব থাকা খুবই কষ্টের এবং লজ্জারও। কিন্তু ভাই আমার একটা ছোট্ট প্রশ্ন আছে। দেশ থেকে যদি শেষ পর্যন্ত অন্যায়, দুর্নীতি দূর না হয় তাহলে কি আমরা উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াতে পারবো?

লোকাটার প্রশ্ন শুনে উপস্থিত সবাই সমর্থন জানাতে শুরু করেন, ঠিক ঠিক… কথা ঠিক…। সঙ্গে সঙ্গে অন্যায়, দুর্নীতির ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন কয়েকজন।

বালিশ-কাণ্ড, পর্দা কেলেঙ্কারি, রুবেল-বরকতের ভূমি দস্যুতা, স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম, ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া সহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে শুরু করলো সবাই। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একজন প্রতিবাদের সুরে বলল, আমরা আর কোনো দেশের অনুকম্পা, সাহায্য চাই না। নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চাই। কিন্তু দেশ থেকে দুর্নীতি দূর না হলে সেটা কি আদৌ সম্ভব?

এটাই হলো মূল কথা। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য নীতি আদর্শ ও সুশাসন জরুরি। দুর্নীতি থাকলে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের চূড়ান্ত মর্যাদা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে আরও পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এই পাঁচ বছরে দুর্নীতির সূচক কমিয়ে আনাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। অন্যায় দুর্নীতি কমলেই দেশে সুশাসন বৃদ্ধি পায়। আর সুশাসন গুরুত্ব পেলেই উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

যে যাই বলি না কেন, দেশের সাধারণ মানুষ অনেক বেশি দেশপ্রেমিক। দুর্নীতির সূচকে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ নেই, তারা দুর্নীতি করতে ভয় পায়। কথাটা আরও সহজ করে বলি। দুর্নীতি করলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষের এমনই ধারণা। অপরদিকে বিপরীতমুখী ধারণা দেশের অসাধারণ মানুষদের! যাদেরকে আমরা বিত্তশালী বলি। তার মানে সব বিত্তশালীই দুর্নীতিবাজ নয়। কিন্তু দেশের দুর্নীতির তালিকায় বিত্তশালীদের নামই দেখতে পাওয়া যায়।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, এই দেশে সাধারণ একটা বালিশ কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। একটা বালিশের দাম দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। শিক্ষাখাতে দুর্নীতি যেন প্রকাশ্য বিষয়। কে না জানে, থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, শিক্ষা ভবন এমনকি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগগুলো ঘুষের রাজত্বে পরিণত হয়েছে।

রেল হচ্ছে সবচেয়ে সাশ্রয়ী বাহন। অথচ আমাদের দেশের রেল ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। সীমাহীন দুর্নীতির কারণে রেল ব্যবস্থা বলতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন রেলের ১৩টি খাতের দুর্নীতি চিহ্নিত করে ১৫টি সুপারিশ দিয়েছে রেলমন্ত্রীকে।

শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, এমপিওভুক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, জাতীয়করণ সহ অবসরে যাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পেনশনের টাকা তুলতেও ঘুষ দিতে হয়। শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগে প্রকাশ্যে চলে সরকারি অর্থের যথেচ্ছ অপচয় আর লুটপাট।

রেল হচ্ছে সবচেয়ে সাশ্রয়ী বাহন। অথচ আমাদের দেশের রেল ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। সীমাহীন দুর্নীতির কারণে রেল ব্যবস্থা বলতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন রেলের ১৩টি খাতের দুর্নীতি চিহ্নিত করে ১৫টি সুপারিশ দিয়েছে রেলমন্ত্রীকে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতির কথা তো সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।

পনেরো হাজার টাকার ঋণের বকেয়া পরিশোধ না করায় কোমরে দড়ি বাঁধা হয়। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকাশ্য দুর্নীতি করেও অনেকে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়। দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কথা নাই বললাম। স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা নিয়োগসহ দুর্নীতির ১১ খাত চিহ্নিত করেছে দুদক। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি এখনও।

দেশের দুর্নীতির ফিরিস্তি দেয়ার জন্য আমার এ লেখা নয়। তবে একটি স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথা বলতে চাই। আর কতদিন আমরা অন্যের কাছে হাত পাতবো? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা সুযোগ এসেছে।

উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের মর্যাদা পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। সেই সুযোগকে আমরা কাজে লাগাতে চাই। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়ে আমাদের সবার কাজ করতে হবে। দেশ আমার, আমাদের। এর মান-মর্যাদা রক্ষায় কেউ আর দুর্নীতি করবো না। এটা যেন আমরা সবাই মেনে চলি…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ব্রেকিং নিউজ :