এস এম জামান, এটিভি সংবাদ
শিরোনাম দেখে বিস্মিত হবার কিছু নেই! একটি সম্প্রদায় পশুর মতো এক হাত থেকে অন্য হাতে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, নিরুপায় বিক্রি হওয়া মেয়েটি। মানুষরুপী কিছু অমানুষের বিকৃত রুচির খোরাক হচ্ছে লাখ লাখ ভারতীয় মেয়ে। অপহরণের পর জবরদস্তি করে বিয়ের নামে বেচাকেনা করা হচ্ছে তাদের। সারাজীবনের জন্য ক্রীতদাসের জীবনযাপন করতে হচ্ছে এবং মেনে নিতে হচ্ছে অকথ্য ও স্থায়ী নির্যাতন।
এমনই একজন অভাগা মেয়ের নাম সানাই। অপহরণ করে প্রথম যখন সানাইকে বিক্রি করা হয়, তখন ওর বয়স ছিল ১২ বছর। যে লোকটা সানাইকে কিনেছিল তার বয়স ছিল ৫০ এর কাছাকাছি। সানাইকে কেনার কিছুদিনের মধ্যেই তার একটা বাচ্চা হয়। বছর চারেক পর সানাইয়ের মালিক এক মার্ডার মামলায় জেলে যায়। অনিশ্চিত ফিরে আসা ভেবে তাকে আবার বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হলো।
এবার সানাইকে জোর করেই কেনে এক অমানুষ। অকথ্য নির্যাতন করতো সে সানাইয়ের উপর। সেই অমানুষটা তাকে খেতে পর্যন্ত দিত না, মাঠে কাজ করাতে নিয়ে যেত আর তার মুখের মধ্যে মাটি ঢুকিয়ে পেটাতো। এই সানাই কিন্তু ভারতে প্রতিদিন বিক্রি হওয়া লক্ষ লক্ষ “দাসীবধূর” মাত্র একটা উদাহরণ।
ভারতে ছেলে শিশুর আশায় গর্ভপাত এবং কন্যা শিশুহত্যার হার এমনিতেই অনেক বেশি এবং এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিন। বিশ্বের নারী-পুরুষের ভারসাম্যহীনতার উপরও তার প্রভাব পড়ছে। এভাবে মেয়ের সংখ্যা কমতে কমতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে হরিয়ানায় বিয়ের যোগ্য ছেলেদের জন্য বিয়ের যোগ্য মেয়ে প্রায় পাওয়াই যাচ্ছে না।
আর এই সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষরূপী অমানুষ ব্যবসায়ী মেয়ে বেচাকেনার ব্যবসা শুরু করেছে। এরা অন্যান্য রাজ্য থেকে শিশু কন্যাদের অপহরণ করে হরিয়ানার পুরুষদের কাছে এনে তাদের বিক্রি করতে থাকে।
আমি না পেরেছি পালিয়ে যেতে, না পেরেছি জীবনটাকে শেষ করে দিতে। এমন কেউই ছিল না যার কাছে আমি অল্প একটু সাহায্য চাইতে পারি। বলছিলেন এভাবেই বিক্রি হওয়াদের আর একজন সানজিদা।
ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রায় দশ হাজারেরও বেশি গৃহবধূর উপর একটি জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে যে, তাদের মধ্যে নয় হাজারের বেশি বিবাহিত মহিলাই অন্য কোন রাজ্য থেকে এসেছে!
আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে যে, হরিয়ানা রাজ্যের গ্রামগুলিতে বাস করা মহিলাদের কোন না কোন সময় তিনবারেরও বেশিবার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামবাসীরা এদেরকে ডাকে ‘পারোস’ বলে। একটা অবমাননাকর শব্দ যা দ্বারা গ্রামবাসীরা বোঝাতে চায় তাদেরকে কিনে আনা হয়েছে।
এই সানজিদাকে যখন হরিয়ানাতে পাচার করা হয় তখন সে ছিল ১০ বছরের কিশোরী। সানজিদা জানায়, তার বাড়ির পাশের গ্রামের তার চেয়ে বেশি বয়সী একটা মেয়ে তাকে নেশাজাতীয় কিছু একটা খাইয়ে তাকে অপহরণ করে। আমাকে তৈরি করা হয়েছিল মাঠে কাজ করার জন্য এই যেমন ঘাস কাটা, গরুকে খাওয়ানো, অন্য আর সব কাজ করা। আমি এক বছর ধরে শুধু কেঁদেই গেছি, আমাকে প্রায় চার বছর বন্দী করে রাখা হয়েছিল।
সানজিদা বলতে থাকে, এর কিছুদিন পরই তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। আমি না পালিয়েও যেতে পারছিলাম না, না পারছিলাম জীবনটাকে শেষ করে দিতে। এমন কেউ ছিল না যার কাছে আমি অল্প একটু সাহায্য চাব।
অন্য যে সব দাসীবধূ, যাদেরকে বিয়ের নামে বিক্রি করা হয়েছে তাদের থেকে একদিক দিয়ে সানজিদা সৌভাগ্যবান ছিল বলতে হয়, কেননা সে বলছিল তার স্বামী তার সাথে অনেক ভাল ব্যবহার করত। সানজিদা এখন একটা এনজিওতে কাজ করে, তার মতো অবিচারের শিকার হওয়া নারীদেরকে সাহায্য করার একবুক আশা আর পাথর সমান দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।
হরিয়ানার সব মানুষই নারীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, সবাই বলে আমাদের কোন মর্যাদা নেই। আর আমাদেরকে তো গরু-ছাগলের মতন বেচাকেনা করাই হয়। এইসব ভাবলে আমার অসম্ভব রকম খারাপ লাগে আমরা মানুষ বলেই হয়তোবা কিংবা সবাই আমরা ভারতীয় এজন্যও এমন অনুভব হতে পারে।
সানাইকে তার নির্যাতনকারী পাষণ্ড স্বামীর হাত থেকে উদ্ধার করার পর এই সানজিদাই এখন সানাইকে সাহায্য করে চলেছে। তার দেড় বছর বয়সী বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে সানাই এখন একটা নিরাপদ বাসায় থাকে, কিন্তু সানজিদা জানায় সানাই এখনও এতোটাই ভীত-সন্ত্রস্ত যে, সে এখনও কাউকে বলে না সে আসলে কোথা থেকে এসেছে।
এককথায় ওর দ্বিতীয় স্বামীটা ছিল পাশবিক, শয়তানটা ওকে এমনভাবে মারধর করত যে ওর মুখটা পর্যন্ত ভেঙে গিয়েছিল এবং সে মানসিকভাবেও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ওর এমনকি কথা বলতে কিংবা বুঝতেও সমস্যা হতো।
নারী তো পণ্যের মতই, অসংখ্যবার ব্যবহার করা যায়, বারবার বিক্রিও করা যায়। গৃহবধূরা তাদের নির্যাতনকারী বয়স্ক স্বামীর কাছ থেকে কোনভাবে পালিয়েও আসতে পারে, পালিয়ে এসে তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠোকা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। হরিয়ানার স্থানীয় প্রধান জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নরেন্দ্র সিং এমনটাই বলছিলেন।
এই ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, দাসীবধূ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোর্টে জবানবন্দি দেওয়ার আগেই সানাইকে নিয়ে আসা হয়েছিল। যে সানাইকে বেচে দেয় সে আবার খুবই ক্ষমতাবান একজন। যার সাথে তার সম্প্রদায়ের রাঘব বোয়ালদের যোগাযোগ ছিল এবং সম্প্রদায়ের সমর্থনও তার পক্ষে ছিল। তো এই পরিস্থিতিতে মেয়েটার জন্য অভিযোগ করে সেটায় অনড় থাকা খুবই কঠিন। আর সেই নারী পাচারকারীকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে সাফ উত্তর দেয়- মেয়েদের কোন অধিকারই নেই, উত্তরাধিকার থাকার তো প্রশ্নই আসে না।
ভারতের জনসংখ্যা ফাউন্ডেশনের পরিচালক পুনম মুত্রেজা আরও বলেন, দাসীবধূদের প্রতি আমাদের যে আচরণ সেটা সামগ্রিকভাবে নারীদের ওপর শ্রদ্ধাহীনতারই একটি সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশ। এটা শুধু লিঙ্গ নির্বাচন কিংবা ভ্রূণহত্যায় মধ্যে আটকে নেই, সত্যি বলতে, এটা মেয়ে শিশুহত্যা আর মেয়েদের কে মূল্যহীন ভাবা নিয়ে।
মুত্রেজা জানান, হরিয়ানা তে নারীদের সংখ্যা হ্রাস এখানকার পুরুষদের অন্যান্য রাজ্য থেকে বউ কিনে আনাকে আরও সহজ করে দিয়েছে। তারা তাদের ছেলেদেরকে দেশের অন্যপ্রান্তের মেয়েদের সাথে সহজ এবং সম্মানজনক উপায়ে বিয়ে দিতেই পারে, কিন্তু এটা নারীজাতিকে চরমভাবে অসম্মান করা যে তারা মেয়েদের কে কেনাবেচা আরম্ভ করে দিয়েছে।
ভারত সরকার এখন দেশের প্রথম সর্বাঙ্গীণ পাচারবিরোধী আইনের খসড়া প্রণয়ন করতে যাচ্ছে কিন্তু কিছু মানবাধিকার কর্মীর মতে এটাও যথেষ্ট হবে না দাসীবধূ কেনাবেচা ঠেকাতে।
আবার সানজিদার কথায় আসি, চার সন্তান নিয়েই এখন সানজিদার জীবন চলছে। তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, নারীদের কেনাবেচা করার এই প্রথা তার প্রজন্মেই শেষ হবে, সেটা অন্তত তার পরিবারের জন্য হলেও হতে হবে। সানজিদার আশা আমি নিজের জন্য বেশি কিছু চাই না কিন্তু আমি যথাসাধ্য পরিশ্রম করি আমার মেয়েগুলিকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য যাতে তারা আরও ভাল একটা জীবন পায়। যা কিছুর মধ্য দিয়েই আমি গেছি, তারা যেন কোনভাবেই আমার মত ভুক্তভোগী না হয়।