নিউজ ডেস্ক, এটিভি সংবাদ
বৃষ্টি বাড়তে শুরু করেছে তিন দিন ধরে। ফসলের জন্য তো বটেই, ইলিশপ্রেমীদের জন্য তা নিয়ে এসেছে সুদিনের বার্তা। গত দুই দিনে চাঁদপুরের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে প্রায় এক হাজার মণ ইলিশ এসেছে। তবে জেলে ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছর একই সময়ে দিনে দুই থেকে তিন হাজার মণ ইলিশ আসত। এবার ইলিশ কম, দাম অত্যধিক বেশি।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি আবদুল বারি জমাদার বলেন, গত দুই মাস বৃষ্টি কম থাকায় ইলিশ নদীতে তেমন আসেনি। এখন আসতে শুরু করলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগও নয়।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মূলত তিনটি কারণে দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমছে।
ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। কারণ, আমরা যে সময়ে ওই নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছি, ওই সময়ে ইলিশ হয়তো বাংলাদেশের নদ-নদী ঘুরে চলে যাচ্ছে, আর অন্য দেশের সীমানায় গিয়ে ধরা পড়ছে। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার কথা ভাবা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০০৭-০৮ সালের পর দেশে গড়পড়তায় ইলিশের আহরণ ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ লাখ ৩২ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়ে। এর আগের বছরের তুলনায় ইলিশের আহরণ বাড়ে ৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ বেড়ে আহরণ হয় ৫ লাখ ৫০ হাজার টন। ২০২০-২১ সালে ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়ে হয় ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়ে আহরণ করা হয় ৫ দশমিক ৬৫ হাজার টন। অবশ্য এই হিসাব সংশ্লিষ্ট অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিবছর ইলিশ কতটা ডিম পাড়ল, তার ওপর একটা সমীক্ষা করে। তাতে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ইলিশের ডিম পাড়ার হার ১১ শতাংশ বেড়েছে। সাধারণত ডিম যে পরিমাণে বাড়ে, ইলিশও তার কাছাকাছি পরিমাণে বাড়ে। কিন্তু ওই একই সময়ে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ; অর্থাৎ ডিম পাড়ার হারের চেয়ে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিমাণ অর্ধেক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বাজারে গত দু-তিন বছর ইলিশের দাম বেশ চড়া। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই মাছ আহরণ করা হয়। যাঁরা এই মাছ ধরেন, তাঁদের নৌকার ভাড়া ও তেলের খরচ ছাড়া আর কোনো বড় ব্যয় নেই। তারপরও দেড়-দুই হাজার টাকা কেজি দরে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। তার মানে, যে পরিমাণ ইলিশ আহরণ করা হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের মতে, যে তিনটি কারণে দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমছে, তার মধ্যে প্রথমত, সাগর থেকে দেশের নদী-মোহনায় ইলিশ আসার পথে অনেক ধরনের বাধা তৈরি হয়েছে। দেশের মেঘনা অববাহিকা এখন ইলিশের সবচেয়ে বড় বিচরণকেন্দ্র। দেশে সারা বছরে যে পরিমাণে ইলিশ হয়, তার ৫৬ শতাংশ আসে বঙ্গোপসাগর থেকে। ৩০ শতাংশ মেঘনা অববাহিকায় ও বাকি ৪ শতাংশ পদ্মা নদী থেকে আসে। সাগর থেকে মেঘনায় ইলিশের ঝাঁক আসার পথে কমপক্ষে দেড় শ ডুবোচর তৈরি হয়েছে। এসব চরের কারণে ইলিশ ততটা আসতে পারছে না।
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০০৭-০৮ সালের পর দেশে গড়পড়তায় ইলিশের আহরণ ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ লাখ ৩২ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়ে। এর আগের বছরের তুলনায় ইলিশের আহরণ বাড়ে ৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।
দ্বিতীয়ত, মেঘনা থেকে পদ্মা পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে দূষণ বেড়েছে। একই সঙ্গে নদীতে মাছের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব খাদ্য কমেছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে গত চার বছর খাদ্যের পরিমাণ কমার হার ৬ শতাংশ। আর দূষণের কারণে ইলিশ নদীতে আসছে না, এলেও দ্রুত সরে যাচ্ছে। ফলে নদীতে ইলিশ কম আসছে।
তৃতীয়ত, দেশের বর্ষাকালের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। বর্ষার নতুন পানি ও জোয়ার-ভাটার কারণে ইলিশ এ সময়ে সাগর থেকে নদীতে বেশি আসে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। এ বছর জুলাইয়ে তা ৫০ শতাংশ কমেছে। বৃষ্টি কম থাকায় ইলিশও কম ধরা পড়ছে।
জানতে চাইলে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম বলেন, ওই তিন বাধা ছাড়াও সাগর থেকে নদীতে আসার পথে জেলেরা বিশাল লম্বা জাল পেতে বসে থাকেন। ফলে ইলিশ সহজে নদীতে প্রবেশ করতে পারে না। ডিম পাড়া বৃদ্ধির সঙ্গে সমান্তরাল হারে ইলিশের আহরণ না বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দূষণ ও বেশি পলি পড়ার ফলে অনেক ডিম ঠিকমতো নিষিক্ত হয় না। যে কারণে ডিম পাড়ার মতো একই হারে মাছের সংখ্যা হয়তো বাড়ছে না।