রাজবাড়ী প্রতিনিধি, এটিভি সংবাদ
সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য সরকার দিলেন (পিবিজিএসআই) প্রকল্পের অর্থ। আর সেই অর্থ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বলছেন, শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজের যাকাতের টাকা দিয়েছেন। এমনই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার সাদীপুর আমিনা ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. আব্দুল মালেকের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারের বরাদ্দ করা পারফরমেন্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশন্স (পিবিজিএসআই) প্রকল্পের ৫ লাখ টাকার ২০ শতাংশ সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তা হিসেবে প্রত্যেকে ৫ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও সঠিক বন্টন করেননি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ আব্দুল মালেক।
এদিকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের দাবি- সরকারি কোন প্রকল্পের টাকা বিতরণ অনিয়ম করেননি তিনি। ব্যক্তিগত যাকাতের টাকাই ৪-৫ জন শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদ্রাসার কেরানির মাধ্যমে বিতরণ করেছেন।
অপর দিকে রাজবাড়ী সদর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বলছেন, পিবিজিএসআই প্রকল্পের টাকা বিতরণে অনিয়ম করার সুযোগ নেই। বরাদ্দ করা টাকা খরচে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্নয়নের নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, পারফরমেন্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশন্স (পিবিজিএসআই) প্রকল্পের স্কুল/মাদ্রাসা/কলেজ ব্যবস্থাপনা জবাবদিহি অনুদানের আওতাভুক্ত হয়েছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার সাদীপুর আমিনা ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, চর শ্যামনগর দাখিল মাদ্রাসা, কাজী হেদায়েত হোসেন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বেলগাছি আলিমুজ্জামান স্কুল এন্ড কলেজ, আলাদীপুর উচ্চ বিদ্যালয়, মাটিপাড়া কাজী ছমির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, চর জৌকুড়ী উচ্চ বিদ্যালয়, আড়াবাড়ীয়া উচ্চ বিদ্যালয় সহ ৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পাঁচটি খাতে ব্যয় করার জন্য ৫ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, ব্যয়ের খাতগুলোর একটি হলো ৫ লাখ টাকার মধ্য থেকে সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তা ব্যয় ২০ শতাংশ হিসেবে ১ লাখ টাকা ব্যয় করবেন। সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তার ব্যয়ের ক্ষেত্রে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার/একাডেমিক সুপারভাইজার, প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং শিক্ষক প্রতিনিধি সমন্বয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে ভূমিহীন, গৃহহীন, অতিদরিদ্র, দুঃস্থ, এতিম, নদী সিকন্তি ইত্যাদি পরিবারের শিক্ষার্থীদের এ সহায়তা প্রদান করতে হবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের ২০ জন শিক্ষার্থী প্রতিজন ৫ হাজার টাকা করে সহায়তা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে দিতে হবে।
সরজমিন ঘুরে জানা গেছে, সাদীপুর আমিনা ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্রী মুক্তা খাতুনকে কয়েকদিন পূর্বে বান্ধবী সামিয়া তার বাড়িতে এসে ৮০০ টাকা হাতে দিয়ে চলে গেছে। দেওয়ার সময় শুধু বলছে, মাদ্রাসার জাফর স্যার (কেরানি) দিতে বলেছে। কীসের টাকা দিলে গেলো মেয়ের বান্ধবী সামিয়া? মাদ্রাসার টাকা এখন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে শিক্ষার্থী মুক্তা খাতুনের মা খালেদা বেগমের।
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া ও সপ্তম শ্রেণির রাবেয়া বশ্রী বলেন, ‘গত মাসের শেষ সপ্তাহে মাদ্রাসার জাফর স্যার আমাদের হাতে ২৫০০ টাকা দিয়ে বলে- উপর থেকে কেউ যদি ফোন দেয়, তাহলে বলবে ৫ হাজার টাকা বুঝে পেয়েছি। ২৫শ টাকা পেয়ে কেন ৫ হাজার টাকার কথা বলবো- বুঝতে পারছি না!’ এর কয়েকদিন আগে মাদ্রসার সানজিদার, কামনা সহ কয়েকজনকে ২৫০০ টাকা দিয়েছেন।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রুমানা আক্তার বলেন, ‘আমার বান্ধবী সুমাইয়া, ঐশী ২৫০০ টাকা পেলেও আমি সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে থাকি কিন্তু আমাকে টাকা দেয়নি জাফর স্যার (কেরানি)।’
একই মাদ্রাসার জান্নাতুল নামে আরেক ছাত্রী বলেন, ‘আমার বান্ধবী ইতিসহ কয়েকজন ১২০০ টাকা করে পেয়েছে মাদ্রাসা থেকে। কিন্তু আমি পাইনি, আমিও তো কাগজপত্র দিয়েছিলাম।’
মাদ্রাসাছাত্রী মুক্তার খাতুনের মা খালেদা বেগম অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার দেবরের মেয়েকে মাদ্রাসার জাফর মাস্টার (কেরানি) ২৫০০ টাকা দিলে বলেছেন- যদি উপর থেকে ফোন আসে বলবে ৫ হাজার টাকা পেয়েছি। এর একদিন পরই আমার মেয়ে মুক্তার বান্ধবীর মাধ্যম দিয়ে মাদ্রাসা থেকে ৮০০ টাকা পাঠিয়ে দেয়। কেউ পায় ২৫০০ টাকা আবার কেউ পায় ৮০০ টাকা। এখন এই টাকা নিয়ে মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে।’
অনুদানের অর্থ না পেয়ে মাদ্রাসা ছাত্রী রুমানা আক্তারের পিতা রুবেল শেখ আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভূমি ও গৃহহীন বিধায় সরকারি আশ্রয়ন প্রকল্পের উপহারের ঘরে থাকি। রাত্রে কুঠিরহাট বাজার পাহারা দেওয়ার কাজ করি। মেয়ের ক্লাসের বান্ধবীরা ২৫০০ করে টাকা পেলেও আমার মেয়েকে টাকা দেওয়া হয়নি।’
শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও স্থানীয়রা বলেন, ‘মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও কেরানির উচিত ছিলো এটা কোন বরাদ্দের কীসের অর্থ, জনপ্রতি পরিমাণ কত এটা পরিস্কার করে তারপর বিতরণ করা। একটা বিষয়ই খটকা লাগছে সকল অভিভাবকের মনে, মাদ্রাসা থেকে কাউকে ৮০০, ১২০০ ও ২৫০০ টাকা প্রদান করে কেন ৫ হাজার টাকা পেয়েছি এটা বলতে বললেন? এভাবে চললে-শুধু শিক্ষার্থীদের অর্থ নয়, সকল অর্থ বিতরণে অনিয়মের মাধ্যমে পুকুর চুরি হবে।’
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোবাইল ফোনে মো. আব্দুল মালেক মিডিয়াকে বলেন, ‘সরকারের বরাদ্দকৃত সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তার অর্থ বিতরণে আমি কোন অনিয়ম করিনি। আমার ব্যক্তিগত যাকাতের টাকা মাদ্রাসার কেরানী মো. জাফর এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ৪-৫ জনের মাঝে বিতরণ করেছি।’
মাদ্রাসার কেরানী মো. জাফর বলেন, ‘মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মালেক স্যারের যাকাতের টাকা দিয়েছি। সরকারি কোন অনুদান থেকে শিক্ষার্থীদের কোন টাকা দেওয়া হয়নি।’ ২৫০০ টাকা দিয়ে ৫ হাজার টাকা পেয়েছি- শিক্ষার্থীদের একথা কেন বলতে বলেছেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে একথা বলিনি।’
রাজবাড়ী সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মধু সূদন সাহা বলেন, ‘সাদীপুর আমিনা ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার প্রাপ্তি পিবিজিএসআই প্রকল্পের টাকা বিতরণে অনিয়মের বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। এ বিষয় অবশ্যই আমরা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে সতত্যা যাচাই করবো এবং যদি সত্যতা প্রমাণিত হয় তাহলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করবো।’
তিনি বলেন, ‘পিবিজিএসআই প্রকল্পের ৫ লাখ টাকা অনুদানের ২০ শতাশ অর্থ ১ লাখ টাকা প্রতিষ্ঠানের সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তা ব্যয় করতে হবে। সেই হারে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের ২০জন শিক্ষার্থী প্রতিজন ৫হাজার টাকা পাবে।’
এটিভি/এসএম/০৪০৪২৪