অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, এটিভি সংবাদ
দুর্নীতি রক্ত মাংসের সাথে মিশে ভয়ানক ভাইরাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি সেক্টরের রন্দ্রে রন্দ্রে মিশে আছে মহামারী আকারে দুর্নীতি। দুর্নীতির কোনো ঘাটতি নেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও। আজকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘাপলা।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই বড় ধরনের ঘাপলা হয়েছিল। ফলে দীর্ঘ সময়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) সহকারী প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আদালতে দাখিল করা হয় চার্জশিট (অভিযোগপত্র)। সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হলে চাকরিবিধি অনুযায়ী তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আইন আছে। কিন্তু অভিযুক্ত প্রকৌশলীর ক্ষেত্রে তা এখনো করা হয়নি। তিনি বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। দুদকের আইনজীবীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত পর্যন্ত করেননি, বরং উল্টো তাকে দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু স্কয়ার’ নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পে পরিচালকের দায়িত্ব। এ নিয়ে আরডিএ-এর অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
কেনো কামরুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে আরডিএ-এর চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) আনওয়ার হোসেন বলেন, এসব ঘটেছে আমার আসার আগেই। বিষয়টি সম্পর্কে আমি বিস্তারিত অবগত নই। তবে এ সংক্রান্ত নথিপত্র আরডিএতে থেকে থাকলে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হবে।
জানা গেছে, কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাজশাহী বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হয় ২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি। মামলায় তাকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে আরডিএ-এর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুর রব জোয়ার্দ্দারকেও অভিযুক্ত করা হয়। তারা সবাই জামিনে থাকলেও কামরুজ্জামান ছাড়া বাকি দু’জন অবসরে গেছেন।
দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৪ সালে শেখ কামরুজ্জামান সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) পদে নিয়োগ পান। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের পরই প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু রহস্যজনকভাবে আরডিএ-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান ওই লিখিত পরীক্ষা বাতিল করেন। যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে পরে শুধু মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে পছন্দের প্রার্থী কামরুজ্জামানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে বঞ্চিত প্রার্থীরা অভিযোগ দিলে প্রাথমিক অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে দুদক এর সত্যতা পায়। দুদক সূত্র জানায়, লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন শেখ কামরুজ্জামান। এছাড়া ১৯৯৩ সালে তিনি মানবিক বিভাগ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। এরপর একটি প্রাইভেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাশ করেন।
এদিকে সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগের ওই লিখিত পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী। তাদের বাদ দিয়ে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সাবেক উপ-পরিচালক আব্দুল করিম ওই মামলা করেছিলেন। পরে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ফরিদুর রহমান রাজশাহীর আদালতে চার্জশিট দেন। দুদকের সচিব ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবকে কামরুজ্জামানের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে চিঠি দেন। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব লুৎফুন নাহার ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর আরডিএ চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, চাকরির বর্তমান অবস্থা এবং মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাওয়া হয়। আরডিএ কর্তৃপক্ষ এসবের কিছুই পাঠায়নি বলে মন্ত্রণালয়ের সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, আদালতে চার্জশিট জমা হওয়ার পর কামরুজ্জামান উচ্চ আদালত থেকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন নেন। তাকে নিম্ন আদালতে হাজির হতে বলা হয়। তিনি আগাম জামিন বর্ধিত করার আবেদন করলেও হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ তা নাকচ করে দেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে কামরুজ্জামান আপিল বিভাগে আবেদন করেন। কিন্তু এখনো তার আবেদন গৃহীত হয়নি। তবে তিনি নিম্ন আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। এ ব্যাপারে শেখ কামরুজ্জামান জানান, তিনি আদালত থেকে জামিনে আছেন। তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা অথবা না করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার।
যার নামে এতো অন্যায় ও পাহাড়সম অভিযোগ রয়েছে সেই সহকারী প্রকৌশলী, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) শেখ কামরুজ্জামান কি করে চাকরিতে বহাল থাকে? যার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে সত্যতা পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলা হয় যার বিরুদ্ধে, সে কি করে থাকে চাকরিতে? সাময়িক বরখাস্ত পর্যন্ত করা হয়নি শেখ কামরুজ্জামানকে।