নিউজ ডেস্ক, এটিভি সংবাদ
সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানি এবং একটি উন্নততর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থায় পৌঁছাতে সংশ্লিষ্টদের মহাপরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে বিশুদ্ধ পানীয়জল এবং উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করুন। তিনি বলেছেন, ঢাকা মহানগরে ২৬০ কোটি লিটার পানির চাহিদা থাকলেও ঢাকা ওয়াসা এখন ২৭০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে। চাহিদার চেয়ে বেশি পানি উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ঢাকা ওয়াসার। পানির বিল এখন ১০০ শতাংশ আদায় করতে সক্ষম ওয়াসা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা ওয়াসার ‘দশেরকান্দি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্টের (পয়ঃশোধনাগার) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ একক পয়ঃনিষ্কাশন শোধনাগার। একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) সহায়তায় পাগলা সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্টের পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এটির পয়ঃনিষ্কাশন ক্ষমতা ২০ কোটি টন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে বিশুদ্ধ পানীয়জল এবং উন্নত সুয়ারেজ ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমার গ্রাম, আমার শহর প্রকল্পের অধীনে সরকার বিশুদ্ধ পানীয়জল এবং উন্নত সুয়ারেজ সুবিধা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চায়।
দেশবাসীকে পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, গ্রামের মানুষ তাদের নাগালের মধ্যে সমস্ত শহুরে সুযোগ-সুবিধা পাবেন। আপনারা অপ্রয়োজনে পানি এবং বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন না, দয়া করে এগুলো ব্যবহারে সাশ্রয়ী হোন। আপনিও এতে উপকৃত হবেন, কারণ এতে বিলও কম হবে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমন্বিতভাবে এ সংক্রান্ত মাস্টারপস্ন্যান তৈরির নির্দেশ দেন।
রাজধানীর আশপাশের নদীগুলোকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে এই পস্ন্যান্ট মুখ্য ভূমিকা পালন করবে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, দাশেরকান্দি পস্ন্যান্টের দৈনিক ৫০ লাখ টন পয়ঃনিষ্কাশন শোধনের ক্ষমতা রয়েছে যা রাজধানীর মোট পয়ঃনিষ্কাশনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
শেখ হাসিনা বলেন, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের শুভ উদ্বোধন করেছি, ইতিমধ্যে আরেকটি পাগলা পয়ঃশোধনাগারের ভিত্তি স্থাপন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতায় তখন ঢাকা শহরে মাত্র ৬০ ভাগ মানুষ সুপেয় পানি পেত। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল এক কোটি বিশ লাখের মতো। পানি উৎপাদন হতো ১২০ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসার পানির বিল মাত্র ৬৪ শতাংশ আদায় হতো। রাজস্ব আয় ছিল মাত্র ৩০০ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতার হত্যাকান্ডের সময় আমি আর আমার ছোট বোন জার্মানিতে ছিলাম। মিলিটারি ডিক্টেটর আমাদের দেশে আসতে দেয়নি। ৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করে। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর জনগণ এবং দলের নেতাকর্মীদের ওপর ভরসা করে আমি এক প্রকার জোর করে দেশে চলে আসি। তারপর থেকে শুরু হয় সংগ্রাম।
শেখ হাসিনা বলেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত না থাকলে কোনো দেশের উন্নতি হয় না। পৃথিবীর কোনো দেশে মিলিটারি ডিক্টেটর উন্নতি করতে পারে না, এটা হলো বাস্তবতা। ২১ বছর সংগ্রামের পর ৯৬ সালে আমরা সরকারে আসি, মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা মেটানোর জন্য প্রথম সায়েদাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্ট নির্মাণ করি। সেভাবে শুরু হয় আমাদের পথ চলা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলব এবং বাংলাদেশকে বদলে দেব। সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। ঢাকা ওয়াসা শহরের পানি সরবরাহের স্থায়ী সমাধানের জন্য ২০১৪ সালে একটি ওয়াটার মাস্টারপস্ন্যান প্রণয়ন করে। এই পরিকল্পনার আওতায় পদ্মা নদীর তীরে জশলদিয়া এলাকায় দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি শোধন করে ঢাকা শহরে সরবরাহের জন্য পদ্মা পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প এবং মেঘনা নদীর পানি ব্যবহার করে ধলপুর এলাকায় ৪৫ কোটি লিটার পানি শোধন ক্ষমতার সায়েদাবাদ ওয়াটার পস্ন্যান্ট ফেস-১, ফেস-২, ফেস-৩ আমরা করি। সবগুলো আওয়ামী লীগ আমলে করা। ইতোমধ্যে পদ্মা পানি শোধনাগার চালু করা হয়েছে, বাকি দুটির কাজও চলমান রয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে উৎস থেকেই ৭০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা যাবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়ান, ঢাকা ওয়াটার সাপস্নাই অ্যান্ড সুয়ারেজ অথরিটির (ওয়াসা) ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইবরাহিম উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশকে ডিজিটাল করতে সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঢাকা ওয়াসা তাদের কার্যক্রমের ৭০ শতাংশ ডিজিটালাইজড করেছে উল্লেখ করে ঢাকা ওয়াসার প্রধান নির্বাহী তাকসিম এ খান বলেন, পদ্মা ও সায়েদাবাদ ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্ট সম্পূর্ণ অটোমেটেড করা হয়েছে। উন্নয়নের মহাসড়কে সরকারের যাত্রায় আমরা সঙ্গী। এছাড়া সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্লাইঅ্যাশ, পয়ঃশোধনের উপজাত, সিমেন্ট কারখানায় বিক্রি করা হবে। পরে তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। দাশেরকান্দি শোধনাগার পস্ন্যান্ট, যা খিলগাঁও থানার অন্তর্গত, আফতাবনগর সংলগ্ন এবং গুলশান (একাংশ), বনানী, তেজগাঁও, নিকেতন, মগবাজার, মালিবাগ, আফতাবনগর, বাড্ডা, কলাবাগান, পান্থপথ, ধানমন্ডি (একাংশ) ও হাতিরঝিলসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার পয়ঃশোধনের ব্যবস্থা করবে।
উল্লেখ্য, চীনের অর্থায়নে ৩ হাজার ৪৮২.৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৬২.২ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। এই অর্থের ১ হাজার ১০৬.৪২ কোটি টাকা জিওবি তহবিল থেকে, ১০ কোটি টাকা ওয়াসার তহবিল থেকে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। প্রকল্পটির বাকি ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যাংকটি থেকে সহায়তা হিসেবে আসবে।
প্রকল্পটিতে প্রতিদিন প্রায় ৫৬০ টন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতাসহ একটি সস্নাজ ড্রাইং-বার্নিং সিস্টেম রয়েছে। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট। পাওয়ার চায়নার অধীনে চেংডু ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন দ্বারা ডিজাইন ও নির্মিত প্রকল্পটি এক বছরের অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ঢাকার চারপাশে নদী দূষণ রোধে পাঁচটি ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্ট নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে ওয়াসার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার পস্ন্যান্টটি নির্মিত হয়েছিল। প্রকল্প অনুযায়ী, প্রগতি সরণিতে রামপুরা সেতুর পশ্চিম পাশে একটি বর্জ্য উত্তোলন স্টেশন, রামপুরা থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার ট্রাঙ্ক সুয়ার লাইন এবং দশেরকান্দিতে মূল শোধনাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা ওয়াসা, দাশেরকান্দি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্ট ও পাগলা সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্টের পৃথক তিনটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
এটিভি/এস
